শষ্যভান্ডারখ্যাত বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায় ২৩০টি বয়লার হাসকিং মিল (চাতাল) মূলধন হারিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। অটো চালকলের দাপটে টিকতে পারেনি তারা। কোনোটার মেশিনপত্র নষ্ট, আবার কোনোটা ভেঙে গড়া হচ্ছে অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এতে সাত হাজারের বেশি নারী-পুরুষ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। কোথাও কাজ না পেয়ে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদমদীঘি উপজেলায় দেশের সর্ববৃহৎ খাদ্যগুদাম সান্তাহার সিএসডি ও সাইলো রয়েছে। আশির দশকে আদমদীঘি সদর, সান্তাহার, নসরতপুর, চাঁপাপুর, কুন্দগ্রাম, ছাতিয়ান গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় চাল ব্যবসায়ীরা ধান সেদ্ধ ও মাড়াইয়ের জন্য বয়লার হাসকিং মিল বা চাতাল নির্মাণ করেন। সে সময় চাতালমালিকরা ধান-চালের এই ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা অর্জন করায় তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
সেখানে কর্মসংস্থান হয় সাত হাজারের বেশি নারী ও পুরুষের। তারা দিন-রাত ধান সেদ্ধ ও শুকানোর কাজ করতেন। পরে চাতাল-মালিকরা ব্যবসা বড় করতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উপজেলায় অটো রাইস মিল স্থাপন শুরু হয়। তখন চাতাল-মালিকদের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তবে অটো রাইস মিলের সংখ্যা বাড়ায় মালিকরা প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে ব্যর্থ হন। মূলধন হারিয়ে তারা চাতাল ব্যবসা বন্ধ করতে শুরু করেন।
আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিস সূত্র জানায়, বর্তমানে উপজেলায় মোট চাতাল রয়েছে ২৮৪টি ও অটোরাইস মিল (স্বয়ংক্রিয় চালকল) ১৪টি। সরকারি চুক্তি ভঙ্গ করায় ৫২টি চাতাল ও তিনটি অটোরাইস মিলের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। এখনও ১১টি অটোরাইস মিল ও ৫৪টি চাতাল চালু রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে উপজেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন।
সংগৃহীত চালের মধ্যে প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন সরবরাহ করেছে, অটোরাইস মিল। অবশিষ্ট ৭০০ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করেছে, চাতাল।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ী মতিউর রহমান জানান, চাতালে প্রতিদিন ৭৫ কেজি ওজনের ১৪০ বস্তা ধান প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে অটোরাইস মিলে দিনে তিন হাজার মেট্রিক টনের বেশি ধান প্রয়োজন হয়। উৎপাদনক্ষমতার এই বিশাল ব্যবধানের কারণে তাল মেলাতে না পেরে ও মূলধন হারিয়ে একের পর এক চাতাল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অপর ব্যবসায়ী হেলালুর রহমান বলেন, নানা কারণে স্বয়ংক্রিয় চালকল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা টিকতে পারছি না। এর অন্যতম কারণ হলো ধান থেকে চাল উৎপাদনের আনুপাতিক হার। সাধারণ চালকলে প্রতি মণে ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয় ২৫ কেজি। অথচ স্বয়ংক্রিয় চালকলে প্রতি মণ ধানে প্রায় ২৮ কেজি চাল পাওয়া যায়। তাদের চালকলে ধান থেকে যে গুঁড়া ও তুষ বের হয়, তার বাজারমূল্য অনেক কম। স্বয়ংক্রিয় চালকলে ৬০০ মণ ধান থেকে চালের কুড়া বের হয় প্রায় ৪০ বস্তা। এসব কুড়ার প্রতি ৫০ কেজি ওজনের বস্তার দাম প্রায় দুই হাজার টাকা। চালের কুড়া থেকে ভোজ্য তেল, মাছ ও পশুখাদ্য তৈরি হওয়ায় এর বাজার চাহিদা অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় চালকল মালিকরা স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ পান। ধান কাটার পরপরই বেশি পরিমাণ ধান কিনে রাখতে পারেন। যা সাধারণ চালকল-মালিকরা পারেন না। এসব কারণে চাতালগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বয়লার চালকলের শ্রমিক আছিয়া বেগম, রেহেনা বেগম, মর্জিনা বেগম, আনিসুর ইসলামরা বলেন, চাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাত হাজারের অধিক নারী ও পুরুষ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। কেউ কেউ অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গোলাম রব্বানী জানান, অটো রাইস মিলের সংখ্যা বৃদ্ধি, ধানের বেড়ে যাওয়া ও মূলধন হারিয়ে অনেক চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এ উপজেলায় ২৩০টি চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। এসব চাতালের মধ্যে ১৭৮টি একেবারে বন্ধ ও ৫২টি সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহ করতে না পারায় তদের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
বর্তমানে উপজেলায় ৫৪টি বয়লার হাসকিং মিল বা চাতাল এবং ১১টি অটোরাইস মিল চালু রয়েছে বলে জানান এ খাদ্য কর্মকর্তা।