পূর্ব মাদারটেকের শরীফবাগ এলাকায় মসজিদ না থাকায় এলাকাবাসীকে একসময় দূরের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে হতো। সেই দুর্ভোগ লাঘবে এলাকার সবাই মিলে টাকা দিয়ে জায়গা কিনে সেখানে তিলে তিলে গড়ে তোলেন মসজিদ। কিন্তু মসজিদ গড়ে তোলার পর এখন নতুন দুর্ভোগে পড়েছেন সেখানকার মুসল্লিরা। মসজিদের জায়গা দখল করেছেন পাশের এক প্রভাবশালী। শুধু তাই নয়, মসজিদে যাওয়ার রাস্তা দখলে নিয়ে তা বন্ধ করে তুলে দিয়েছেন দেয়ালও। বিষয়টি নিয়ে এলাকার এমপি পদক্ষেপ নিলেও রাজউককে ম্যানেজ করে প্রভাব খাটাচ্ছে সেই দখলবাজ চক্র। এ নিয়ে ওই এলাকায় মুসল্লিদের চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পূর্ব মাদারটেকের সিঙ্গাপুর রোড ও এর আশপাশের বাসিন্দারা নামাজের জন্য ২০১৮ সালে এলাকাবাসী নিজ অর্থায়নে একটি জমি ক্রয় করে মসজিদের নামে ওয়াকফাহ করা হয়। এরপর তারা ওই জমিতে বহুতল মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মসজিদ নির্মাণের কাজ। মসজিদের পেছনের অংশের মালিক সাবিনা মমতাজ নামের একজন। তিনি পূর্ব মাদারটেক ওই মসজিদের পেছনের অংশের কিছু জমি অবৈধ দখল করে ইতোমধ্যেই বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন।
এর প্রতিবাদে এলাকাবাসী ভবনটির নকশাবহির্ভূত অবৈধ অংশ ভাঙার জন্য এবং দক্ষিণ বনশ্রী সড়ক থেকে মসজিদের প্রবেশের সড়কটি খুলে দেওয়ার জন্য রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর গত ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল আবেদন করে। আবেদনের পর রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট অথরাইজ অফিসারকে ভবনের নির্মাণ বন্ধ করা এবং নকশাবহির্ভূত অংশ ভাঙার জন্য নির্দেশনা দিলেও তা অদ্যবদি বাস্তবায়ন হয়নি। রাজউকের ওই কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ভবন নির্মাণের কাজ করছেন ওই প্রভাবশালী চক্রটি- বলছেন এলাকাবাসী।
এদিকে, বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী গত ১০ মার্চ স্থানীয় এমপি এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ুমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর কাছে ভবনটি ভাঙার জন্য আবেদন করলে, মন্ত্রী রাজউক চেয়ারম্যানকে লিখিত নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভবনটি নির্মাণ কাজ যাতে না হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দেশ অমান্য করে পুলিশ ও রাজউকে ম্যানেজ করে ৮ তলা ওই ভবনের কাজ শেষ পর্যায়। গত সপ্তাহে সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংসদ সদস্যের নির্দেশনা পেয়ে নির্মাণাধীন ভবন থেকে কর্মরত অবস্থায় ১০/১২ জন শ্রমিককে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখবে এই শর্তে সবুজবাগ থানায় মুচলেকা দিয়ে নির্মাণশ্রমিকদের ছাড়িয়ে আনেন ভবনমালিক। পরবর্তীতে আবারও সবুজবাগ থানায় মুচলেকা ভঙ্গ করে ভবনমালিক নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এলাকাবাসী সূত্র বলছে, ভবনমালিকদের একজন শামীম প্রভাবশালী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। সেই সঙ্গে তার রয়েছে অঢেল ‘কালোটাকা’। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি না থাকলেও টাকার জোড়ে স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে শুরু করে থানা ও রাজউককে ম্যানেজ করে রেখেছে। তার সঙ্গে রয়েছে এলাকার একটি সন্ত্রাসী চক্র। তারা প্রভাব খাটিয়ে ভবননির্মাণ কাজ করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শামীমের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
এলাকাবাসী জানায়, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দক্ষিণ বনশ্রী সড়ক থেকে সাবিনা মমতাজ তাদের জমির পাশ দিয়ে মসজিদে মুসল্লিদের আসার প্রবেশ পথে দেয়াল উঠিয়ে প্রবেশ পথটি বন্ধ করে দেয়। ফজর নামাজ পড়তে আসা দক্ষিণ বনশ্রীর মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করতে না পেরে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। গত শুক্রবার সকালে ঘটনার সংবাদ পেয়ে স্থানীয় এমপি এবং পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী সবুজবাগ থানা পুলিশকে মুঠোফোনে জানান, মুসল্লিদের নামাজ পড়তে আসার সড়কটিতে সীমানা প্রাচীর দ্রুত ভেঙে দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন এবং এলাকাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে সেই ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে, সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর ঘটনাস্থলে এসে দক্ষিণ বনশ্রী সড়ক থেকে মসজিদে প্রবেশে অবৈধ সীমানা প্রাচীর ভেঙে দেয়। এরপর মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করে জুমার নামাজ আদায় করেন। পরে মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে গত শুক্রবার দুপুরে সবুজবাগ থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করা হয় (নং- ১৪৯২)। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে রাজউকে আবেদনের পরও রহস্যজনক কারণে রাজউক কর্তৃপক্ষ ভবনটি ভাঙার বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ভবনটি যাতে রাজউক কর্তৃপক্ষ ভাঙতে না পারে সেজন্য ভবনমালিক উচ্চ আদালতে বেশ কিছুদিন পূর্বে একটি রিট দাখিল করেন। আর রাজউক কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে রিটটি খারিজের বিষয়ে এ পর্যন্ত কোনও কার্যত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের অথরাইজড অফিসার ঝোটন দেবনাথ এবং রাজউকের এরিয়া পরিদর্শক তন্ময় দেব ওই ভবনমালিকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ গ্রহণ করে। যার কারণে ভবনটির বিরুদ্ধে রাজউক চেয়ারম্যানের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে ভবনটির অবৈধ অংশ ভাঙার ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
এলাকাবাসী আরও জানান, ভবনটি উঠার সময় থেকে প্রতিনিয়ত রাজউক কর্তৃপক্ষকে নকশাবহির্ভূত কাজের বিষয়ে বারবার লিখিত ও মৌখিকভাবে অবহিত করা হয়েছিল। রাজউক যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে ভবনটি এতদিনে ৮/৯ তলা পর্যন্ত নির্মাণ হত না। ওই ভবনের পাশ দিয়ে মসজিদে আসার প্রবেশপথ প্রস্থ সোয়া তিন ফুট ও লম্বায় প্রায় ১০০ ফুটের সরু সড়কটি বন্ধ হয়ে গেলে দক্ষিণ বনশ্রীর প্রায় কয়েক হাজার বাসিন্দারা এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারবে না।
এদিকে, ভবনমালিক ওই সড়কের উপর থেকে (দ্বিতীয় তলা থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত) ভবনের টয়লেট নির্মাণ করেছে। এতে করে সড়কে নিচ দিয়ে চলাচলকারী মুসল্লিদের জামা-কাপড়ে নোংরা পানি পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজউকের এরিয়া পরিদর্শক তন্ময় দেব বলেন, ওরা প্রভাবশালী থাকার কারণে আমরা কাজ করতে পারছি না। অথরাইজড অফিসারের ঘুষ খেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্যার এই ধরনের মানুষ না। আইনি জটিলতার কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। আপনি অফিসে আসেন তখন বিস্তারিত বলবো।
তিনি আরও বলেন, মসজিদ একটা পবিত্র জায়গা। তাই মসজিদের জায়গা নিয়ে করা ঠিক হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের আইন-শাখায় নথিটি পাঠিয়েছি। তারাও কাজ করছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেনকে মুঠোফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ত আছি। এখন এ বিষয় কথা বলতে পারব না। এদিকে রাজউকের অথরাইজড অফিসার ঝোটন দেবনাথকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।