Monday, May 19, 2025

মধ্যবিত্ত হাসি | ক্যাম্পাস


সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে কোনো পিতা-মাতারই চেষ্টার কমতি থাকে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মহান মাতা-পিতাকে নিয়ে পরিবারের বাইরে একটি বিশেষ স্থানে আমার ঈদ কাটানোর এক স্মৃতিময় পাঠ উপস্থাপন করছি এখানে।

সময়টা তখন ২০১৮ সাল, ২৪ বা ২৫ রমজান, রাত ১১টা। চারবন্ধু একসাথে আমার রুমে গ্রুপ স্টাডি করছিলাম। হঠাৎ সেই শব্দ, ভয়ঙ্কর শব্দ। বন্ধুরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি টিউবওয়েলের দিকে ছুটলাম, এক বালতি পানি তোলার আগেই পরিবারের সবাই হাজির। আপনারা কিছুই বুঝতে পারছেন না তাইতো?

ঘটনা হলো, আমার আব্বা একজন ব্রেইন টিউমারের রোগী।  মাঝে মধ্যে উনি ঘুমন্ত অবস্থায় একটা শব্দ করে সেন্সলেস হয়ে যান এবং প্রচণ্ড খিচুনি ওঠে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তখন মাথায় প্রচুর পানি ঢালতে হয়, কখনো কখনো বাড়তি ওষুধ খাওয়াতে হয়। প্রেসারটা ঠিক জায়গায় চলে আসলে লম্বা একটা ঘুমের পর উনি মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। বেশীরভাগ সময় এমনটাই হয়ে থাকে।

কিন্তু সেদিন ঘটলো এর উল্টো। পানি ঢালা, ওষুধ খাওয়ানো কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে বাবার খিঁচুনি ক্রমশঃ বেড়েই চললো। চোখ দুটো লাল থেকে আরও লাল হতে শুরু করলো। অবশেষে উপায় না পেয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্সযোগে যাত্রা শুরু করলাম। সাথে ছিলেন আম্মা, বড় দুলাভাই এবং রুহুল ভাই। 

হয়তো আপনারা ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন যে আমার স্মৃতিময় ঈদটা কোথায় হয়েছিল।

যেহেতু ঈদ উদযাপন নিয়ে গল্প বলা, সেহেতু মেডিক্যালে চিকিৎসা বিষয়ক ইতিহাস টেনে গল্পটাকে মলিন করতে চাই না। সরাসরি চলে যাবো ঈদ উদযাপনে।

ঈদের আগের দিন আব্বা মোটামুটি সুস্থ, তবে সম্পূর্ণ না। রুম, বারান্দা এর বাইরে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, সুযোগ পেলেই  তিনি বাইরের খোলা পরিবেশে যেতে চাইতেন। কিন্তু আমরা তা করতে দিতাম না। সকাল-বিকাল সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা সি-ব্লকের সামনের মনোরম পরিবেশে বাবাকে থাকতে দেওয়া হতো, তারপর নিয়ে আসতাম। কিন্তু তিনি আরও বেশি থাকতে চাইতেন। জোরপূর্বক ভেতরে নিয়ে আসলে উনি রেগে যেতেন, চুপ করে বসে থাকতেন।

আমি বুঝতে পারলাম যে হসপিটালের চার দেয়ালের ভেতরে তিনি ক্লান্ত। এভাবে রাখলে তিনি হয়তো আবারও অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। পরিকল্পনা করে ঠিক করলাম প্রত্যেক দিন বিকেলে তাকে নিয়ে বাইরে বের হবো। শাহবাগের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখাবো। এতে উনার মনটা ফ্রেশ হবে। কিনতু ডাক্তার রাজি হলেন না। কারণ বাইরে অসুস্থ হয়ে গেলে পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস ছিল এমন কিছু হবে না। অবশেষে ডাক্তারকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে পারলাম মানে অনুমতি পেলাম। তবে ডাক্তার হাসপাতালের আশেপাশে থাকার কথা বললেন। এরপর প্ল্যান করলাম কোনদিন কোথায় যাবো।

ঠিক করলাম ঈদের দিন শিশু পার্কে, দ্বিতীয় দিন জাদুঘরে, তৃতীয় দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্পটে এবং পরবর্তীতে হাসপাতালে থাকলে কোথায় যাবো, তা পরে ঠিক করবো।

ঈদের দিন হাসপাতালের ভেতরে নতুন কাপড়, ভালো খাবারের চিন্তা মাথায় নেই। ভালো থাকার চিন্তাটাই বেশি। তবুও সবার খুশি রাখতে আমার চেষ্টার অন্ত ছিল না। ঈদের দিন আমার বড়ভাইও আমাদের সাথে ছিলেন। বড়ভাই থাকার পরেও সার্বিক দায়িত্বটা আমিই পালন করেছিলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে ভালো খাবার এনে সবাই মিলে খেলাম। বাড়ির ভাইবোনদের সাথে ফোনে কথা বললাম। দুপুরের পর আম্মা, আব্বা, বড়ভাই ও পরিকল্পনা মতো শিশুপার্কে গেলাম। সেখানে ঘণ্টা খানেক সবাইকে নিয়ে ঘুরলাম।

তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে একটি বেঞ্চে বসলাম। সংক্ষেপে সবাইকে শিশুপার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিচয় দিলাম মানে ইতিহাস বললাম। বুঝতে পারলাম সবাই খুশি হয়েছেন। কারণ একটি ঐতিহাসিক স্থানে আসতে ভালো লেগেছে। তারপর আরও কিছুক্ষণ সেখানে ঘুরে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে হাসপাতালে চলে আসলাম। হাসপাতালে এসে আব্বাকে বললাম, এখন থেকে প্রত্যেক দিন বিকেলে ঘুরতে যাব। আর বাকি সময় ঠিকমতো ঘুমাবেন, খাবেন এবং রেস্ট নিবেন।

কথামতো আব্বা রাতে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালেও বের হলেন না। শান্তি মতো দিন কাটাচ্ছে, শুধু কিছুক্ষণ পরপর সময় জিজ্ঞেস করতেন।

কেন জানেন? কারণ আমি আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম বিকাল ৩টায় ঘুরতে যাব। তিনি শুধু ৩টার অপেক্ষায় থাকতেন। ৩টায় আম্মা, আব্বা আর ভাইকে নিয়ে জাদুঘরে গেলাম। জাদুঘরের বিভিন্ন গেলারি ঘুরে দেখালাম। ঐতিহাসিক নিদর্শন, বিরল সংগ্রহ, নীল তৈরির কড়াই, বাদ্যযন্ত্র, প্রাণির কঙ্কাল, ভাস্কর্য,  মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি, আর্ট গ্যালারিসহ আরও অনেক কিছু দেখালাম এবং পড়ে পড়ে শুনালাম। পরে গরমের কারণে ১-২ ঘণ্টা ঘুরে দেখার পর সবাইকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসলাম। এ অল্প সময়ের ভেতরে জাদুঘরের বেশিকিছু পর্যবেক্ষণ করতে পারিনি। তাই সবাইকে হাসপাতালে রেখে আমি আবার জাদুঘরে যাই এবং আরও অনেক কিছু দেখি।

ঈদের তৃতীয় দিন শুধু আব্বাকে নিয়ে বের হয়েছিলাম। জাদুঘরের সামনে দিয়ে গিয়ে নজরুলের সমাধি, জাতীয় গ্রন্থাগার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্পটে ঘুরলাম। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার পর শহিদ মিনারের সামনে এসে বসলাম এবং আব্বাকে নিয়ে কফি খেলাম, গল্প করলাম। অতঃপর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। 

ঈদের চতুর্থ দিন আব্বাকে নিয়ে আবার সোহরাওয়ার্দীতে গিয়েছিলাম। কারণ তিনি বলছিলেন, ওখানের পরিবেশটা তার খুব ভালো লেগেছে। এর পরেরদিন আর বের হইনি। এরপরের দিন অর্থ্যাৎ ঈদের ষষ্ঠ দিন হাসপাতাল থেকে ছুটি দিলে সবাইকে নিয়ে আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরি।

এটাই ছিল মা-বাবা, ভাইকে নিয়ে আমার জীবনের প্রথম বৈচিত্র্যময় শ্রেষ্ঠ ঈদ উদযাপন। কেননা দিনশেষে আব্বাকে ফিরে পেয়েছিলাম। হাসপাতালের মধ্যে থেকেও তাদের মনে ঈদের খুশি কিছুটা হলেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম। তাছাড়া সে সময় আমার ওপর অনেক অজানা-অচেনা দায়িত্ব এসেছিল। আমি আল্লাহর অশেষ কৃপায় দায়িত্বগুলো সফলভাবে পালন করতে পেরেছিলাম।

সেজন্যই ঈদের স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর মধ্যে এটা আমার কাছে সেরা। এটাই আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যবিত্ত আনন্দময় ঈদ।

-শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন-

পুরোনো সেই ঈদের স্মৃতি

ভাইবোনের কাণ্ড

আব্বুকে হারানো ঈদ

জলরঙের ঢেউ



Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles