Sunday, November 3, 2024

বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?


রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা অধিকাংশ বাসের অবস্থা খুবই নাজুক। বাসগুলো রং ওঠা, বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা, জানালাগুলোও প্রায় খুলে পড়ার মতো অবস্থা। এসব দৃশ্য প্রতিনিয়তই দেখা যায় ঢাকার সড়কগুলোয়।

এ ছাড়া সড়কে তীব্র প্রতিযোগিতা করে এক বাস অন্য বাসের যাওয়ার পথ অবরুদ্ধ করে রাখে। এতে পেছনের বাসটি সামনের বাসকে ধাক্কা দিতে থাকে। যে কারণে বাসের পেছনের অংশ ভেঙে উধাও হয়ে যায়।

এমন পরিস্থিতি দেখে নাখোশ ও লজ্জিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সম্প্রতি এসব বাসের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। বাসের পেছনের অংশ উধাও হয়ে যাওয়ার পরও সড়কে দিব্যি চলছে এগুলো। এসব বাসের ছবি তুলে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, ‘বাসগুলোর এই দশাই দেশের গণপরিবহন অব্যবস্থাপনার চিত্র।’

রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাসের চালক ও সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন এমন অবস্থা হয় বাসগুলোর, কেনই বা তারা এসব লক্কড়ঝক্কড় বাস নিয়ে রাস্তায়, জানালেন নেপথ্যের কাহিনি।

জানতে চাইলে বাসচালক ও সহকারীরা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিরিয়াল নেওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে বাসগুলোর এই অবস্থা। এসব বাসের মধ্যে কোনও শৃঙ্খলা নেই। একই কোম্পানি তবে বাস-মালিক ভিন্ন। দিন শেষে প্রতিটি বাস-মালিক চালকদের থেকে হিসাবও নেয় আলাদাভাবে। ফলে কোম্পানি নয় বাস-মালিকদের কাছে দায়বদ্ধ বাসচালকরা।

পুরনো বাস নতুন দেখানোর জন্য বারবার ঝালাই ও রং করে রাখা হয়

তারা আরও বলেন, বেশির ভাগ বাস-মালিক চুক্তিতে চালকদের কাছে বাসের চাবি দেন। চুক্তি অনুসারে দৈনিক জমা দেওয়ার পর বাকিটা বাস শ্রমিকদের আয়। ফলে তাদের মধ্যে বেশি যাত্রী তুলে বেশি আয়ের প্রতিযোগিতা থাকে। প্রতিযোগিতার কারণে একই রুটের বাসগুলো একটি অন্যটির যাওয়ার পথ অবরুদ্ধ করে রাখে। এতে পেছনের বাসটি সামনের বাসকে ধাক্কা দিতে থাকে। যে কারণে বাসের পেছনের অংশ দ্রুতই ভেঙে যায়। একসময় সেই অংশ উধাও হয়ে যায়।

তবে বাসের পেছনের অংশ ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার জন্য পথ ও বাস্তুহীন শিশুদের দায়ী করেছেন কোনও কোনও বাসের সহকারী। তারা বলছেন, ইদানীং বাসের পেছনের অংশ ভেঙে দুর্বল হয়ে গেলে পথশিশুরা তা খুলে নিয়ে যায়। এ ছাড়া পুরনো বাস নতুন দেখানোর জন্য বারবার ঝালাই ও রং করে রাখা হয়। এতে দুর্বল অংশ দুর্বলই থেকে যায়।

মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ী রুটের শিকড় পরিবহনের একটি বাসের সহকারী রাজিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেইন ধাক্কাধাক্কি হয় তো যাত্রাবাড়ীতে। আগে সিরিয়াল নিতে পারলে আগে গাড়ি ঘোরানো যায়। আর আগে থাকলে সামনের সব যাত্রী আমার।’

বিহঙ্গ পরিবহনের বাসের চালক সিরাজ বলেন, ‘এমনিতেই যাত্রী কমে গেছে। এক জায়গায় অনেকক্ষণ দাঁড়ায়া থাকতে হয় যাত্রীর জন্য। আর সামনে যদি কোনও গাড়ি না যাইতে দিয়া একটা গ্যাপ তৈরি করতে পারি, তাহলে এই গ্যাপের সময়ে কিছু যাত্রী সামনে জমা থাকে। তাদেরও তো ওঠানোর টার্গেট থাকে। এর জন্য এক জায়গা দুইজন যাত্রীর জন্য দাঁড়ায়া থাইকা পেছনেরটারে সামনে যাইতে দিলে ওই তো যাত্রী নিয়া যাইবো। তাই এমন সিস্টেমে রাখি যেন পিছনেরটা সামনে না যাইতে পারে। তখন পিছনের নম্বর আমারে ধাক্কাইতে থাকে।’

ধাক্কাধাক্কির ফলে বাসের ক্ষয় হয়, মালিকের ক্ষতি হয়, এ বিষয়ে জানতে চাইলে চালক শামসুদ্দিন বলেন, ‘মালিক আমাদের দেখে না। জমা থেকে একটু কম দিলেই গালাগালি করে। সব দিনে যাত্রী সমান পাওন যায় না। নিয়ম করে ভালোমতো চালালেই ওই দিনই যাত্রী কম উঠাইতে হয়। তখন তো মহাজনরে জমা দিয়া আমার কিছু থাকে না। এর মাঝে তেলের খরচ, রাস্তায় এরে ওরে চাঁদার খরচ সব আমারেই দিতে হয়। আবার খাওয়ার খরচ।’

‘বাসের রংটং উঠে গেলেও বাস-মালিকরা কিছু কয় না’

হিসাব দেখিয়ে আরেক বাসচালক সিজান বলেন, ‘এখন মেট্রোরেলের কারণে মিরপুর-গুলিস্তান যাত্রী কমে গেছে। একসময় অফিস টাইমে পারলে জানালা ভাইঙ্গা যাত্রী ওঠে। এখন তিন ট্রিপ সর্বোচ্চ। এর মাঝে যদি ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকার তেল খরচ। রাস্তায় খরচ আছে ৫০০ থেকে ৭০০। জমা আছে ১৫০০ থেকে দুই হাজার। এত কিছু দিয়ে আমার আর হেল্পারের থাকে কত? চাইলেই নিয়মের মধ্যে থাকা যায় না। আগে এক দিন গাড়ি চালাইয়ে আরেক দিন রেস্ট নিতাম। এক দিনের কামায়ে দুই দিন চলতাম কষ্ট করে। এখন যেই অবস্থা প্রতিদিনই গাড়ি নিয়া বের হইতে হয়। তার ওপর কোনও নিশ্চয়তা নাই। আজকেই যা কামাও, পরের দিন যদি চাবি না পাই?’

এ বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বিকল্প পরিবহন কোম্পানির একটি বাসের মালিক নজরুল ইসলাম নান্টু বলেন, ‘বাস রং করে এক মাস যাওয়া যায় না। ধাক্কাধাক্কি করে এদিক-ওদিক দিয়ে রং উঠায়া ফেলে। আমার গাড়ি ধাক্কাধাক্কিতে না গেলেও অন্য গাড়ি ঠিকই চাপ দিয়া যায়। তাই বছরে একবারই ফিটনেস চেকের আগে বাস-মালিকরা ঝালাই করে রং করে। পরে সারা বছর এভাবেই চলে যত দিন চলা যায়।’

ধাক্কাধাক্কিতে মালিকদেরও মৌন সমর্থন থাকে জানিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাস-মালিক বলেন, বাসের সেক্টরে একটা সিস্টেম হয়ে গেছে পাড়াপড়ি-ধাক্কাধাক্কি করে যে যত বেশি লোক উঠাইতে পারবো, সে তত ভালো ড্রাইভার। কারণ রাতে জমা দেওয়ার সময় এরা কোনও ঝামেলা করে না। যাত্রী উঠায়া নিজেরও থাকে, মালিকরেও ঠিকমতো বুঝায়া দেয়। এ জন্য ধাক্কাধাক্কি। এতে বাসের রংটং উঠে গেলেও বাস-মালিকরা কিছু কয় না। মালিকদেরও তো টেনশন ঠিকমতো টাকা না পাইলে খরচ চালাবে কী করে?’

তিনি আরও বলেন, ‘বাসের সার্ভিসের একটা খরচ আছে। কিস্তি থাকলে কিস্তি দেওয়ার চিন্তা। সবকিছু বাদ দিয়া যা থাকে, নিজের জন্য বাসায় নিয়ে যেতে হয়। এখন তো বাসের যে সার্ভিস করাবো, পার্টসগুলার দামও কয়েক গুণ বাড়ছে আগের তুলনায়।



Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles