এবার দৃশ্যমান হলো বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর পৌনে ৪ কিলোমিটার।
সরেজমিনে দেখা যায়, যমুনার বুকে ভারি ভারি যন্ত্র বসিয়ে সারিবদ্ধভাবে নদীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৪৯টি পিলার। উত্তাল যমুনার ওপর দেশের এ মেগা প্রকল্পকে ঘিরে নদীর টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের দুই প্রান্তে দিন-রাত দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও নির্মাণ শ্রমিকরা বিরতহীনভাবে কাজ করছেন। কেউ পাইলিং করছেন, কেউ স্প্যানের কাজ করছেন। আবার কাউকে ঢালাইয়ের কাজ করতে দেখা গেছে।
জানা যায়, এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এরমধ্যে টাঙ্গাইল অংশে ৯২ শতাংশ ও সিরাজগঞ্জ অংশে ৮০ শতাংশের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার এখন দৃশ্যমান।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
সেতুটি চালু হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ট্রান্সএশিয়ান রেলপথে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি বেগবান হবে। যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে দেশের দীর্ঘতম ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।
ডুয়েলগেজের এ সেতুতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যাবে। তবে শুরুতে (উদ্বোধনের ১ বছর) সেতুর ওপর দিয়ে দুইটি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ ট্রেন ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে। প্রায় ৭ হাজার দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও শ্রমিকের দিনরাত পরিশ্রমে দ্রুত এগিয়ে চলেছে রেল সেতুর নির্মাণকাজ।
টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ অংশে দুইটি প্যাকেজের আওতায় ৫০টি পিলার ও ৪৯টি স্প্যানের সমন্বয়ে এ রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪৯টি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা ৩৭টি স্টিলের স্প্যান পিলারের ওপর বসানো হয়েছে। বাকি ১৬টি স্প্যান বসানোর কাজ চলছে। রেল সেতুতে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ দুই ধরনের ট্রেনই সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ তৈরি করতে দুই প্রান্তে ভায়া ডাক ও ৩০ কিলোমিটার ডাবল লাইনের রেলপথের কাজও দ্রুতগতিতে চলছে। সেতুর স্প্যানে স্লিপারবিহীন রেললাইন বসানো হচ্ছে। দেশের রেললাইনে জাপানি এ প্রযুক্তির ব্যবহার এটাই প্রথম। এ প্রযুক্তিতে স্টিল স্ট্রাকচারের গার্ডারের সঙ্গে রেললাইনের সংযোগ প্রযুক্তিতে কোনো স্লিপার থাকবে না।
এদিকে, বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেশের সবচেয়ে বড় এ রেলসেতুতে মোট পিলার (খুঁটি) রয়েছে ৫০টি। ক্রেনের সাহায্যে হ্যামার দিয়ে বসানো হচ্ছে পাইলিং পাইপ। রেলসেতুতে কংক্রিটের পিলার বসানো হচ্ছে। ওপরের সুপার স্ট্রাকচার হচ্ছে স্টিলের। অপরদিকে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণকালীন কিছু ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুমোদিত ইএমপি অনুযায়ী সড়কের ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রকল্প এলাকার জনগণ ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশগত ঝুঁকিতে রয়েছে। আইএমএডি প্রতিবেদনে প্রকল্পের কিছু দুর্বল দিকও প্রকাশ করা হয়েছে। এরমধ্যে রেলওয়ে সড়কবাঁধ নির্মাণে যথাযথ এবং অনুমোদিত পদ্ধতি অনুসরণ না করা, প্রকল্পের কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করা, চুক্তি মোতাবেক প্যাকেজ ডব্লিউডি-২-এর ল্যাবরেটরিতে মেশিনারি ও জনবল মোবালাইজ না করা, প্রকল্পের ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালট্যান্ট নিয়োগ না করা, অনুমোদিত ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অনুযায়ী নির্মাণকালীন সড়কের ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত
ব্যবস্থা করা হয়নি ও প্যাকেজে ডব্লিউডি২ সম্পূর্ণ ল্যাবরেটরি টেস্টিং ইক্যুইপমেন্ট শ্রেণি বিন্যাস করা হয়নি ইত্যাদি।
এক্সিট প্ল্যান হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার প্যাকেজ ভিত্তিক এক বছর সেতু রক্ষণাবেক্ষণ করবে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে প্রকল্পের আওতায় নির্মিত সেতু ও যাবতীয় ভৌত অবকাঠামো হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে এই সেতু এবং ভৌত অবকাঠামোর ডিজাইন লাইফ ১০০ বছর সচল রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, সেতু থেকে রাজশাহী স্টেশন পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার ও ডাবল লাইন না করা গেলে এই রেলসেতু পুরোপুরি কাজে আসবে না। তা ছাড়া ট্রেনে লাগেজ বগিও যুক্ত করতে হবে। স্টেশনগুলোতে পণ্য পরিবহনে বিশেষ করে কাঁচামাল পরিবহনের উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। রাজশাহীতে উৎপাদিত আম, সবজি ও মাছের মতো কাঁচামালের ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করা শিল্প কলকারখানার জন্য কাঁচামাল রেলযোগে সরাসরি উত্তরবঙ্গে আনার সুব্যবস্থাও করতে হবে। তবেই এই রেলসেতুর পুরোপুরি সুফল আসবে।
উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীণ, ক্রস বর্ডার এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ট্রাফিকের বর্ধিত চাহিদা বিবেচনায় রেখে নির্বিঘ্নে নিরবচ্ছিন্ন রেল চলাচল নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিদ্যমান সড়ক সেতুর ৩০০ মিটার উজানে যমুনা নদীর ওপর আরেকটি ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক সম্পন্ন ৪ দশমিক ৮০ কিমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু ও প্রায় ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার ডাবল লাইন সমন্বিত রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ অ্যামবাঞ্চমেন্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলসেতুটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রথম সংশোধনীর পর সেতু প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন থাকছে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বা চার হাজার ৬৩১ কোটি টাকা এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিচ্ছে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। যা পুরো প্রকল্পের ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ জার্নাল/ এমএম