এ বছর প্রথম থেকে তৃতীয় এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে চালু করা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। এই পদ্ধতিতে প্রচলিত পরীক্ষার পরিবর্তে বিভিন্ন কার্যক্রমভিত্তিক শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে শিক্ষার্থীদের। তবে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা যাচাই কেবল ধারাবাহিক বা শিখনকালীন মূল্যায়নেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
ইতোমধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষের তিন মাস পার হয়েছে। শিখনকালীন মূল্যায়নের স্কোর ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপে নিয়মিত ইনপুট দেওয়ার কথা থাকলেও হাতেগোনা দু-চারটি স্কুল বাদে কোনও স্কুলের শিক্ষকই তা করতে পারেননি। বর্তমানে নৈপুণ্য অ্যাপে মূল্যায়ন স্কোর ইনপুট দিতে গেলে স্ক্রিনে ভেসে আসছে ‘নৈপুণ্য এর সকল কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।’ এতে শিক্ষকরা পড়েছেন বেকায়দায় এবং হতাশার মধ্যে পড়েছেন অভিভাবকরা।
নৈপুণ্য অ্যাপ বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘গত ২২ জানুয়ারি থেকে এটি বন্ধ রয়েছে, ছুটির মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে, কাজ চলছে।’
‘একসঙ্গে তিন মাসের মূল্যায়ন ইনপুট কীভাবে দেওয়া যাবে’ জানতে চাইলে মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা কাউকে ব্লক করিনি। তিন মাসের মূল্যায়ন ইনপুট দিতে পারবে। নৈপুণ্য অ্যাপ নতুন হওয়ার কারণে আমরা কাউকে ব্লক করবো না। সব ঠিক হয়ে গেলে ভবিষ্যতে নির্ধারিত সময়ে ইনপুট না দিলে তখন জবাবদিহি করতে হবে।’
নৈপুণ্য অ্যাপে মূল্যায়ন ইনপুট দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জহুরা বেগম বলেন, বর্তমানে অ্যাপটিতে কাজ করতে পারছি না। অ্যাপে ঢুকলে দেখাচ্ছে— ‘নৈপুণ্য এর সকল কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে’। তাই আমরা হার্ড কপিতে মূল্যায়ন প্রস্তুত করছি। মূল্যায়ন অ্যাপ কার্যকর না থাকায় আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠকও করতে পারছি না। বৈঠক ডাকলে তারা জানতে চাইবে মূল্যায়ন সম্পর্কে। কবে নাগাদ এটি ঠিক হবে আমাদের কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।’
নৈপুণ্য অ্যাপে মূল্যায়ন ইনপুট দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার উত্তর মেরামতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. মোকলেসুর রহমান বলেন, অ্যাপ চালুর পর এখন পর্যন্ত শুধু স্কুল ও শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করতে পেরেছি। কাজ করতে না পারায় ঢাকায় এবং রাজশাহীর সংশ্লিষ্ট নম্বরে ফোন করলে তারা জানিয়েছেন, ত্রুটি দেখা দিয়েছে, ঠিক হলে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু ঠিক হয়নি। অ্যাপ ঠিক থাকলে এখন ছুটির সময় বসে মূল্যায়ন ইনপুট দেওয়া যেতো, সেটিও পারছি না।’
ঢাকার প্রধান প্রধান স্কুলসহ জেলা পর্যায়ের কিছু স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের স্কোর ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপে ইনপুট দেননি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্কুলগুলোতেই অ্যাপটির কার্যকর ব্যবহার হচ্ছে না। আর দেশের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত ফেব্রুয়ারি মাস গেলেও শুরুই করতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নৈপুণ্য অ্যাপে বিদ্যালয় রেজিস্ট্রেশন ও শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করলেও এখনও মূল্যায়ন ইনপুট দিতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেছেন ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপটি ব্যবহারোপযোগী নয়। কিছুতেই অ্যাপটিতে তথ্য ইনপুট দেওয়া যাচ্ছে না। সচেতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা ভবিষ্যতে ইনপুট দেবেন সে চিন্তা থেকে আলাদাভাবে মূল্যায়নের স্কোর শিক্ষক ডায়েরিতে তুলে রেখেছেন। তবে বেশিরভাগ শিক্ষকই তা করছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিভাবকরা বলছেন, এখন যদি এনসিটিবি থেকে শিক্ষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় তাহলে দেখা যাবে বেশিরভাগ শিক্ষকই মনগড়া তথ্য দিয়ে ইনপুট দেবেন, যা হবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা।
রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের শিক্ষকরা বলছেন, বিদ্যমান শিক্ষাক্রমে শিখন-শেখানো পদ্ধতি আধুনিক হলেও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শুরু থেকেই অসন্তোষ বিরাজ করছে অভিভাবকদের মাঝে। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। কিন্তু কোনও লাভ হচ্ছে না। অন্যদিকে শিক্ষা গবেষক, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন নাগরিক সমাজের একাংশও মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক বলেন, ‘বছরের প্রথম তিন মাস যথাযথভাবে ক্লাস ও মূল্যায়ন না হওয়ায় সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চরম হতাশার মধ্যে রয়েছি। বর্তমান পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে ভালো স্কোর করলো বা খারাপ করলো সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষকরা সঠিক মূল্যায়ন করলেন কিনা তাও বোঝার উপায় নেই। ক্লাসের জন্য নির্ধারিত পাঠের মূল্যায়ন সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা সেটি আর পড়ার বা রিভিশন দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। আবার সামষ্টিক মূল্যায়ন দলীয় কার্যক্রমভিত্তিক হওয়ার ফলে আলাদা আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত উৎকর্ষ যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের লেখার দক্ষতাও হারিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
কোনো কোনো শিক্ষা গবেষক, বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ও সচেতন অভিভাবকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এই অবস্থার উত্তরণে লিখিত পরীক্ষার বিকল্প নেই। সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রকল্প, প্রতিবেদন ইত্যাদি দলীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি সীমিত আকারে লিখিত পরীক্ষা থাকা দরকার। লিখিত পরীক্ষা অবশ্যই ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক মূল্যায়নের সিলেবাসভিত্তিক করারও দাবি করেন তারা।
মূল্যায়ন পদ্ধতি সহজ করা হবে বলে এর আগে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপর গত ৪ মার্চ নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে একটি সমন্বয় কমিটিও গঠন করে সরকার। কিন্তু সমন্বয় কমিটির কাজের অগ্রগতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। কারণ লিখিত পরীক্ষা কীভাবে হবে, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট নির্দেশনা এখনও দেওয়া হয়নি। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা আস্থা হারিয়ে ক্ষুব্ধ হলেও নাম প্রকাশ করতে চান না।
এরই মধ্যে শুরু হয়েছে প্রায় এক মাসের ঈদের ছুটি। ছুটির পরে ২১ এপ্রিল থেকে আবারও ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। ততদিনে বর্তমান শিক্ষাবর্ষের প্রায় চার মাস অতিক্রম হয়ে যাবে। চার মাসেও মূল্যায়ন শুরু করতে না পারার জন্য এনসিটিবির ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। তারা বলছেন, এত সমস্যা সৃষ্টি না করে পুরো সিলেবাসভিত্তিক সামষ্টিক মূল্যায়ন করতে হবে। আর অবশ্যই নির্দিষ্ট নম্বরের লিখিত পরীক্ষা রাখতে হবে।
যদিও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশনা নেই এনসিটিবির।