Saturday, October 5, 2024

একটি সুস্থ সমাজের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষা‍র্থীদের সুন্দর সম্প‍‍র্ক জরুরি


৫ আগস্টের শিক্ষা‍র্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ সমাজে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এবং মনস্তাত্ত্বিক পরিসরে আমরা একটা রূপান্তর লক্ষ করছি। সময়ের প্রয়োজনে যুগের চাহিদা অনুযায়ী সমাজে রূপান্তর জরুরি হয়ে ওঠে, এটা অনস্বীকা‍র্য। তরুণ প্রজন্ম একবুক আশা নিয়ে এবং একরাশ স্বপ্ন নিয়ে একটি র্ক‍তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান করতে যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তার হাত ধরে সমাজের সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিব‍‍র্তন আসবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক এবং সে পরিব‍‍র্তনকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সেটা যেন অবশ্যই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগকে আঘাত না-করে, ধ‍‍র্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত না-করে এবং সমাজে বিদ্যমান মান-ম‍‍‍‍র্যাদার রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত না-করে।

পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে যে অভ্যুত্থান-পরব‍‍র্তী সমাজের বিভিন্ন স্তরে এক ধরনের গণজোয়ার ঘটে, যা পুরনো ব্যবস্থাকে বদল করে নতুন ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা বিপুল জনসম‍‍র্থনের হাত ধরে সামাজিক ন্যায্যতা পায়। গণঅভ্যুত্থানের পর তাই গণ-আকাঙ্ক্ষার দাবিদার হিসেবে অনেক সময় অনেক অসুন্দর ঘটনা জায়েজ হয়ে যায়। অভ্যুত্থান-পরব‍‍র্তী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট উপস্থিতি, নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ না-থাকায় এসব ঘটনা ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আবার এটাও অনস্বীকা‍র্য যে অভ্যুত্থান পরব‍‍র্তী অনেক সুযোগসন্ধানী এরকম পটপরিব‍‍র্তনের সুযোগে এসব লুটপাটে অংশ নেয়। সমষ্টিগত অ‍‍র্জনকে ব্যক্তিগত গোলায় ভরার ধান্দায় কিছু লোক সমাজে সবসময় থাকে। কিন্তু যে বিষয়টি খুবই উদ্বেগের এবং দুশ্চিন্তার কারণ সেটা হচ্ছে, শিক্ষক ও শিক্ষা‍র্থীর মধ্যকার সম্প‍‍র্কের গুরুতর অবনতি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু স্কুল ও কলেজের শিক্ষা‍‍র্থীরা অত্যন্ত অসম্মান করে, চরম অপমান করে এবং সামাজিকভাবে হেয় করে কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং কলেজের অধ্যক্ষকে জোর করে পদত্যাগ করাচ্ছে, যা অত্যন্ত লজ্জার ও অমানবিক।

শিক্ষকদের অপমান করার এসব দৃশ্য আবার মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে, অনেক শিক্ষককে সামাজিকভাবে চরমভাবে হেয় করা হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এসব শিক্ষকেরও পরিবার আছে, সন্তান-সন্ততি আছে, আত্মীয় পরিজন আছে এবং পাড়া প্রতিবেশী আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে অপমান ও অসম্মান করে তাদের জোর করে পদত্যাগপত্র আদায় করা হচ্ছে, সেটা খুবই লজ্জাজনক, যা তাদের সামাজিকভাবে রীতিমতো পরিত্যক্ত করে দিচ্ছে। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজকে সমাজের একটা বড় অংশ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সম‍‍র্থন করছে। যা শিক্ষকদের অপমান করার জন্য এবং শিক্ষকদের অসম্মান করার জন্য অন্যদেরও উৎসাহিত করছে। ফলে, শিক্ষক-শিক্ষা‍র্থীর মধ্যকার যে স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্প‍‍র্ক সেটা রীতিমতো হুমকির মুখে পড়েছে। আর এসব ঘটনার চেইন-ইফেক্ট হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয় প‍‍র্যায়েও একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে, পুরো শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষা-ব্যবস্থায় একটা বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে।  

আমাদের মনে রাখতে হবে যে শিক্ষকরাও মানুষ। তাদেরও ভুলত্রুটি আছে। কেউ ভুলত্রুটির ঊ‍‍র্ধ্বে নয়। যদি কারও বিরুদ্ধে সুনি‍র্দিষ্ট কোনও অভিযোগ থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। জেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর আবেদন করে প্রয়োজনে তাকে বরখাস্ত করা যেতে পারে। বেসরকারি বা প্রাইভেট কোনও স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা কলেজের প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে, সে স্কুল বা কলেজের পরিচালনা প‍‍র্ষদের মাধ্যমে তাকে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিংবা যদি কেউ ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা করা যেতে পারে। তাকে প্রয়োজনে জেল হাজতে প্রেরণ করা যেতে পারে। কিন্তু স্কুল-কলেজের কিশোর-কিশোরী শিক্ষা‍র্থীদের দিয়ে শিক্ষকদের এভাবে অপমান করা, অসম্মান করা এবং সামাজিকভাবে হেয় করা কোনোভাবেই একটি সুস্থ সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এমনকি কিছু কিছু ভাইরাল হওয়ার ভিডিওতে দেখা যায়, কোনও কোনও স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে জোর করে পদত্যাগ করিয়ে জুতার মালা গলায় পরিয়ে দিয়েছে শিক্ষা‍র্থীরা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আরেকটা ভিডিওতে দেখা গেছে একজন প্রধান শিক্ষককে প্রহার করা হয়েছে এবং একজন শিক্ষা‍র্থী শিক্ষককে প্রহার করতে পারাটাই তার বড় উচ্ছ্বাসের কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে! আরেকজন কলেজের অধ্যক্ষকে এমন মানসিক নি‍র্যাতনের মাধ্যমে পদত্যাগ করানো হয়েছে যে তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোক করেছেন এবং পরব‍‍র্তীতে হাসপাতালে মারা গেছেন।

এসব দৃশ্য বা ঘটনা সমাজকে কী বা‍র্তা দেয়? যারা এসব ঘটনার পক্ষে কথা বলে এসব ন্যক্কারজনক কাজকে আশকারা দিচ্ছেন, তারাও তো কোনও কোনও শিক্ষকের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। তাহলে, শিক্ষকের এ অপমান এবং অসম্মান কীভাবে সমাজে আশকারা পায়? এ প্রশ্নগুলো গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে।

এটাও অনস্বীকা‍র্য যে কিছু কিছু শিক্ষক বিগত সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে, দলীয় ক্ষমতা খাটিয়ে অনেক অন্যায় কাজ করেছেন। সহক‍‍র্মী শিক্ষক ও অনেক শিক্ষা‍র্থীকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছেন। ফলে, পরিব‍‍র্তিত পরিস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ থাকবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে, শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা, জুতার মালা পরিয়ে অপমান করে, অসম্মান করে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এটাও জানি যে অনেক শিক্ষক পটপরিব‍‍র্তনের ফায়দা নিয়ে শুধু চেয়ার দখল করার জন্য কোমলমতি শিক্ষা‍র্থীদের এধরনের আচরণ করতে প্ররোচিত করছে। ফলে, শিক্ষকের ম‍‍র্যাদা বলে যে সমাজে একটা মূল্যবোধ জারি ছিল, সেটা আজ ভূলুণ্ঠিত। শিক্ষক-শিক্ষা‍র্থীর শ্রদ্ধা-স্নেহের সম্প‍‍র্ক যেন হঠাৎ করে ভেঙে পড়েছে। শিক্ষক-শিক্ষা‍র্থীর সম্প‍‍র্ককে যদি আমরা সুস্থ এবং সুন্দর করে গড়ে না-তুলি তাহলে মনে রাখতে হবে, শেষ বিচারে সমাজ টিকে থাকবে না। এ অসুস্থতার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব সমাজদেহে এবং রাষ্ট্রকাঠামোতে পড়বেই। যার নেতিবাচক ফল আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের পরব‍‍র্তী প্রজন্মকে এর করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।

আমাদের পরব‍‍র্তী প্রজন্মের জন্য আমরা কি এরকম একটি অসুস্থ সমাজ রেখে যাব? এসব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে আমাদের একটা সুস্থ সমাজ নি‍র্মাণের দ‍‍র্শন সৃষ্টি করতে হবে।

আশার কথা হচ্ছে, ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি বেশ কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষককে সাধারণ শিক্ষা‍র্থীরা পা ছুঁয়ে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। অনেক স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের ওই স্কুল এবং কলেজের সাধারণ শিক্ষা‍র্থীরা ফিরিয়ে নিয়ে এসে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে। এসব ঘটনা আমাদের আশাবাদী করে তুলে। সমাজে এখনও সত্যিকার শিক্ষা‍র্থী আছে যারা শিক্ষকদের সম্মান করতে জানে এবং করে। শিক্ষকদের বলা হয় দ্বিতীয় জন্মদাতা। নিজের পিতামাতা সন্তানদের বৈজিক জন্মদান করেন কিন্তু শিক্ষকরা অ্যাকাডেমিক ও বুদ্ধিবৃদ্ধিক জন্মদাতা। তাই, শিক্ষকদের সম্মান করা পিতামাতাকে সম্মান করার সমতুল্য। আমরা এটা আশা করছি না, সম্রাট আকবরের আমলের “শিক্ষকের ম‍‍র্যাদা” আজকে শিক্ষকদের প্রাপ্য, কিন্তু সমাজে যে মূল্যবোধের শিক্ষা সমাজকে একটি সভ্য, শালীন ও সুন্দর সংস্কৃতি জারি রাখতে সহায়তা করে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষা‍র্থীর মধ্যকার একটি স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্প‍‍র্ক।

শুধু শিক্ষা‍র্থীদের দিকেই স‍‍র্বদা আঙুল তুললে সেটাও শিক্ষা‍র্থীদের প্রতি অন্যায় হবে, কেননা শিক্ষকদেরও সত্যিকার শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে। সম্মান আপনা-আপনি আসে না, সম্মান অ‍‍র্জন করে নিতে হয়। শিক্ষকরা শিক্ষা‍র্থীর দ্বিতীয় জন্মদাতা কিন্তু সেটা শুধু কাগজে-কলমে বা ভাবাবেগের হাওয়া দিয়ে তৈরি হবে না, নিজের আচরণ, যোগ্যতা, শিক্ষা, দায়িত্বশীলতা ও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষকদেরও সেটা অ‍‍র্জন করতে হবে। আমরা চাই, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক ও শিক্ষা‍র্থীদের সুস্থ ও সুন্দর সম্প‍‍র্ক বজায় থাক, যাতে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজের বিকাশ ঘটে।

 
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।




👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles