Saturday, May 17, 2025

অস্থিরতার মধ্যেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করলেন উপাচার্য


কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) অস্থিরতা সৃষ্টি এবং ক্লাস না করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়ী করেছেন উপাচার্য ড. এ এফ এম আবদুল মঈন। তিনি বলেন, কয়েকজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন। আগেও এসব শিক্ষক আগের উপাচার্যদের অপমান করে বিদায় করেছেন। আমি দুর্নীতি বন্ধ করায় আমাকে তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন থেকে দুর্নীতিমুক্ত।

জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে উপাচার্য ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ আদায় করতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন কয়েকজন শিক্ষক। ক্লাস না করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করছেন।’

এ সময় তিনি ওইসব আন্দোলনকারী শিক্ষকদের শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান উপাচার্য।

সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মীদেরকে সঙ্গে মতবিনিময় করেন এই উপাচার্য। এ সময় উপাচার্য বিগত দিনে শিক্ষক আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় শিক্ষকের অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা, প্রশাসনিক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য এবং শিক্ষা ছুটির নামে অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থানের বিষয়েও বিস্তারিত তুলে ধরেন।

ড. মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিক পরিবেশ নিয়ে প্রশংসার পরিবর্তে বারবার নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছে হত্যা, টেন্ডার, নিয়োগ-বাণিজ্যে ছাত্র-শিক্ষকদের জড়িত থাকার কারণে। মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ছিল না। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে লিডিং ও মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চার নম্বর অবস্থানে রয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এগিয়ে নিতে পরিকল্পনা বা ভিশন কী রয়েছে জানতে চাইলে উপাচার্য ড. মঈন বলেন, উদ্ভাবনে নেতৃত্ব, সমাজের ক্ষমতায়ন, উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা, মানবকল্যাণ, সম্প্রদায়কে সমৃদ্ধ করা এবং টেকসই প্ল্যানেট গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ভিশন তৈরি করি। আর বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেই। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে— বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আয় থেকে মানসম্পন্ন প্রবন্ধ প্রকাশনায় উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষকদের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড ও স্বীকৃতি প্রদান, শিক্ষকদের প্রকাশনার জন্য সম্পাদকীয় প্রণোদনাসহ বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস ও জিএমএটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফিস প্রদান করা। গবেষণার মান বাড়াতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানের বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা, মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর বৃত্তি প্রচলন, ক্রীড়ায় উদ্বুদ্ধকরণের জন্য বৃত্তি প্রচলন, কেন্দ্রীয়ভাবে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করে সেশনজট দূর করা।

উপাচার্য বলেন, শিক্ষকের নতুন পদ অনুমোদনসহ শূন্যপদ পূরণ, মশাবিহীন, স্বাস্থ্যকর, নান্দনিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা, অটোমেশন (ডি-নথি, ওয়েবসাইট, অ্যাপ, ইআরপি, ক্যাম্পাস এরিয়া নেটওয়ার্ক, পেমেন্ট গেটওয়ে) সেবার ব্যবস্থা, এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।

উপাচার্য জানান, তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করতে কেনাকাটা ও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যের সংস্কৃতি বন্ধ করা হয়। একইসঙ্গে উচ্চতর ডিগ্রি করার পরেও বিদেশে থেকে পদ ধরে রেখে শিক্ষক সঙ্কট তৈরি করা ৯ জন শিক্ষকের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা বাবদ ১ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা ফিরিয়ে এনে তাদের শূন্য পদে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দুই বছরে ৭০৩ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় পর্যায়েও প্রশংসিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতিমুক্ত প্রকিউরমেন্ট ও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যের সংস্কৃতি বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৯৫ শতাংশ কেনাকাটা ইজিপির মাধ্যমে করা হচ্ছে। গুণগতমানহীন আসবাবপত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ১ কোটি টাকার টেন্ডার বাতিল করাসহ, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ না করায় জরিমানা আরোপ করি। ফলে প্রথম বছরে সকল উন্নয়ন কাজের অতিরিক্ত ৮০ লাখ টাকার উন্নয়ন ব্যয় করার পরও সরকারের তহবিলে ৩ দশমিক ১৪ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করা, এবং তাদের কর্মের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও তাদের পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিসহ সেবা প্রদান করার জন্য প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছে।

ড. মঈন দায়িত্ব নেওয়ার পরে ছয় মাসের মধ্যে দুর্নীতির কারণে ২০১৪ সাল থেকে চলমান স্থবির একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রকল্পের আওতায় ছাত্রীদের জন্য ‘শেখ হাসিনা’র নামে একটি হলসহ চারটি স্থাপনা নির্মাণ করার কথা জানান।

উপাচার্য দাবি করেন, এসব পদক্ষেপের কারণে দুই বছরে নানা সূচকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দৃশ্যমান। এখন গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এক নম্বর অবস্থানে উঠে এসেছে। এপিএতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০ম স্থানে উন্নীত হয়েছে। সম্প্রতি স্পেন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৮ নম্বর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কুবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জয়ের পরই সভাপতি ড. আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে সমিতির নেতারা উপাচার্যকে কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে অবরুদ্ধ করে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পরেন। শিক্ষকদের পদোন্নতিতে মানসম্পন্ন প্রকাশনার শর্ত থাকলেও সমিতির নেতারা তা তুলে নেওয়ার দাবি করেন এবং অন্যথায় পদত্যাগ করার দাবি জানান।

এছাড়া শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় বাধা দেন।

শিক্ষক সমিতির অতীতের মতো এবারও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করে উপাচার্য দাবি করে বলেন, ‘শিক্ষক সমিতির এই চিহ্নিত নেতারা প্রত্যেক উপাচার্যের সময় একই ধরনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তারা উপাচার্যের কাজে প্রভাব বিস্তার, নিয়োগে প্রভাব বিস্তার করে প্রার্থী’র (শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী) থেকে আর্থিক লেনদেন, টেন্ডার কাজে হস্তক্ষেপ ও অর্থ-আত্মসাৎ, ভূমি বাণিজ্যসহ নানান সুযোগ-সুবিধা নিতে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে উপাচার্যকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার মাধ্যমে হেয় ও জিম্মি করা, সাধারণ শিক্ষকদেরকে র‌্যাগিং দেওয়ার কাজ করেছেন। শিক্ষার্থীদেরকে হুমকি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণসহ অবৈধ কাজ করতে উপাচার্যকে বাধ্য করা, ক্লাস না নিয়ে কোর্স শেষ করা, ইনকোর্সের নম্বর হেরফের করা, যৌন হয়রানি, মার্ক টেম্পারিংয়ের মতো গুরুতর হয়ে অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।

উপাচার্য অভিযোগে জানান, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির পাশাপাশি একটি সিমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করেন। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে এক বছরে নির্ধারিত সংখ্যক কোর্স শেষ করতে না পারায় ফেলোশিপ বাতিল, তিনি দেড় বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য সাড়ে তিন বছর ছুটি কাটানোর অভিযোগ করেন। এসব ছুটি চাইলে সিন্ডিকেট সভায় নাকচ হওয়ায় মেহেদী ভিসির বিরুদ্ধে লাগেন বলে তার দাবি।

শিক্ষক সমিতির সভাপতির সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, ৪৯ দশমিক ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ের ৮ দশমিক ৪ কিলোওয়াটের একটি সোলার প্যানেল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন তিনি। ওই বছরই সোলার প্যানেলটি অকেজো হয়ে পড়লেও সভাপতি তাদের দিয়ে তা মেরামত না করিয়ে বাকি অর্থ দিয়ে দেয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সরেজমিন অভিযানেও প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।

উপাচার্য দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের চুক্তিতে কোষাধ্যক্ষ স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টারে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আলী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন রেজিস্ট্রার ড. আবু তাহের। দুর্নীতি করার সুবিধার্থে কোষাধ্যক্ষকে প্রকল্পের বাইরে রেখে রেজিস্ট্রার নিজেই আইনবহির্ভূতভাবে এ স্বাক্ষর করেন।

প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প ঘিরে সাবেক উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার ড. আবু তাহের দুর্নীতির সুবিধার্থে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজে নিজের গ্রুপের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে যুক্ত করেন। এছাড়া রেজিস্ট্রার থাকাকালে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা সামনে আসে। এছাড়া পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিজ কোরামের শিক্ষকদের পদোন্নতি দ্রুত দিলেও অপছন্দের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতিতে গড়িমসি করতেন বলে জানান কুবি উপাচার্য অধ্যাপক মঈন।



Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles