Monday, June 30, 2025

সাধারণ শিক্ষায় আগ্রহ কমছে, বেড়েছে ধর্মীয় ও কারিগরিতে


ধর্মীয় ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়ছে, অন্যদিকে আগ্রহ কমছে সাধারণ শিক্ষায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে সাধারণের চেয়ে কারিগরির প্রতি আগ্রহ বাড়ার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ ধারায় পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীদের বেকার থাকতে হয়; অভিভাবকদের এমন ধারণা এই পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। তাছাড়া ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ-সুবিধা ও কম খরচের বিষয়টিকেও কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে বিবিএস’র এই পরিসংখ্যানটি বেশি সময়ের পরিসরে করলে পরিবর্তনের প্রবণতা সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাওয়া যেতো বলে অভিমত শিক্ষা খাতের বিশেষজ্ঞদের।

বিবিএস’র তথ্য অনুযায়ী, তিন বছরের ব্যবধানে ধর্মীয় শিক্ষার হার বেড়েছে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ, কারিগরি শিক্ষার হার বেড়েছে দশমিক ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার প্রতি ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষের আগ্রহ কমেছে। ৩ লাখ ৮ হাজার ৩২টি পরিবারের ওপরে সমীক্ষা চালিয়ে ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

গত মার্চ মাসে প্রকাশিত বিবিএসের প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, ২০২১ সালে সাধারণ শিক্ষার হার ছিল ৯৩ দশমিক ২৭ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯১ দশমিক ০২ শতাংশে। অন্যদিকে, ২০২১ সালে ধর্মীয় শিক্ষার হার ছিল ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষাও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে কিছুটা বেড়েছে। ২০২১ সালে কারিগরি শিক্ষার হার ছিল ১ দশমিক ০৬ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা ১ দশমিক ২২ শতাংশ হয়েছে।

এছাড়াও ২০২২ সালে সাধারণ শিক্ষার হার ছিল ৯১ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ধর্মীয় শিক্ষার হার ছিল ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কারিগরি শিক্ষার হার ছিল ১ দশমিক ১০ শতাংশ। অন্যান্য শিক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্য এই হার উঠানামা করেছে। যেমন- ২০২১ সালে অন্যান্য শিক্ষার হার ছিল শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ। আবার ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ। এখানে অন্যান্য শিক্ষা বলতে ফুটপাতে পথশিশু বা বয়োবৃদ্ধদের শিক্ষার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বোঝানো হয়েছে।

সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ার বিষয়টিকে বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেক শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞ। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ার বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছেন অনেকে। শিক্ষাবিদদের মতে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতেই সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। অন্যদিকে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যয়ভার কম। এছাড়াও ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। যার ফলে অভিভাবকদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।

আবার অনেকে এই আগ্রহের জায়গাটাকে খণ্ডিত চিত্র বলেও মনে করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইআর) সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দু-তিন বছরের ডাটা অ্যানালাইসিস করে আসলে এটা বলা কঠিন যে, সাধারণ শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। আমরা যদি গত ১০-১৫ বছরের ডাটা পর্যালোচনা করতে পারতাম তাহলে পুরো বিষয়টা সুন্দরভাবে উঠে আসতো। বিবিএস’র প্রতিবেদনে যে সময়ের চিত্র উঠে এসেছে সেই সময়ের আগে কোভিডের প্রকোপ ছিল। তখন এক বছরের বেশি সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। সে সময়টাতে অনেক পরিবার চিন্তা করেছে এখন বসে না থেকে ধর্মীয় শিক্ষা নেওয়া ভালো বা কারিগরি লাইনে কিছু একটা শিখে রাখা ভালো হবে।

তবে কয়েকটি কারণেই সাধারণ শিক্ষার প্রতি অনেক অভিভাবকের অনাস্থা এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক অভিভাবক এখন তাদের বাচ্চাদের মাদ্রাসায় পড়তে পাঠাচ্ছে। তারা মনে করছে, মাদ্রাসায় দিলে বাচ্চারা ভালো করবে, সাধারণ লাইনে পড়ে কিছু করতে পারবে না। সাধারণ লাইনে পড়াশোনা করলে বেকার থাকতে হবে। তার চেয়ে কারিগরিতে পড়াশোনা করে ভালো কর্মসংস্থান জোগানো যাবে। এরকম একটা প্রচারণা বা প্রবণতা এখন আমাদের সমাজে তৈরি হয়েছে।

বেকারত্ব দূর করতে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার আরও বেশি মানোন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের মতে, কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব কমে যাবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিরন বেগম (লিজা) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষতা অর্জন করে শিক্ষার্থীরা নিজেকে যোগ্যকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে কারিগরি শিক্ষা ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। কারিগরি এবং কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ যত বাড়বে সমাজে বেকারত্ব তত কমে আসবে।

ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি বেসরকারি আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ইসমাইল হোসেন বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের ধর্মীয় জ্ঞান থাকা দরকার। এক্ষেত্রে আলেম-ওলামা হতে হবে, বিষয়টা এমন না। ধর্মীয় জ্ঞান অনেক পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। তাছাড়া ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কেউ কিন্তু বেকার নেই। মসজিদ-মাদ্রাসায় চাকরিসহ কিছু না কিছু করে তারা খাচ্ছে।

‘শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে এখন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। যা অন্য সেক্টরের শিক্ষার্থীদের নেই। সেখানকার মসজিদ-মাদ্রাসায় খেদমতগার প্রয়োজন হয়। বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতেও শিক্ষক প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ থেকে এমন অসংখ্য যুবক সেখানে গিয়ে মসজিদ, মাদ্রাসা ও মানুষের খেদমত করছে। এভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তারা ভালো আয়ও করে।’

ধর্মীয় ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ার পিছনে সামাজিক অর্থনৈতিক অনেক কারণ আছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, এখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক বাড়ছে। প্রত্যেকটা পরিবারের একটা বিপন্ন অবস্থা। এজন্য কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বেকারত্ব থেকে রক্ষা পেতে এই ধরনের শিক্ষাকে একটা আপদকালীন জরুরি অবস্থা বলতে পারি। এটা একদিক থেকে ভালো। আমাদের প্রযুক্তিগত যেসব ঘাটতি আছে তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো। 

‘আর মাদ্রাসার শিক্ষা বাড়ার একটা কারণ হচ্ছে, প্রথমত তাদের প্রচার বেশি। আবার কিছুদিন আগে যে মাদ্রাসার শিক্ষার শেষ ধাপটি মাস্টার্স সমতুল্য করে দেওয়া হলো, মাদ্রাসার প্রতি আগ্রহ বাড়ার এটাও একটা কারণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে মাদ্রাসা একটা দরিদ্র বান্ধব প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসা সম্পর্কে অনেক সমালোচনা শোনা যায়, এটা ঠিক তবে মাদ্রাসায় একটা গরিব বাচ্চাদের জন্য জায়গা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ মাদ্রাসা কিন্তু আবাসিক। ফলে একটা পরিবার যখন তার সন্তানকে দিয়ে দেয় তখন কিন্তু তার ভরণপোষণ থেকে মুক্ত হচ্ছে। এটা কিন্তু আমাদের প্রাইমারি শিক্ষায় এটা করা হয় না’, যুক্ত করেন এই শিক্ষাবিদ।

তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটা ব্যাপারে মাদ্রাসা এগিয়ে আছে, তাদের কিন্তু টিউশনির প্রয়োজন নেই। যেটা স্কুলের শিক্ষায় সবসময় প্রয়োজন হয়। ক্লাস থ্রি ফোর থেকে টিউশনি শুরু হয়ে যায়। সেই তুলনায় মাদ্রাসায় প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে পরিবারের উপর অতিরিক্ত কোনও চাপ থাকে না। আর মাদ্রাসার শিক্ষাটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বিশেষ করে গ্রামে। মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী পাঠানো একটা ট্রেডিশন হয়ে গেছে আমাদের দেশে। আর পাশাপাশি আমাদের মেইনস্ট্রিম যে শিক্ষা ব্যবস্থা তার অনেক দুর্বলতাও রয়েছে।’

সাধারণ শিক্ষার চেয়ে ধর্মীয় ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইংয়ের উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখন সাধারণ শিক্ষা শেষে দেখা যাচ্ছে- অনেক শিক্ষার্থী শুধু সার্টিফিকেটটাই পাচ্ছে আর কোনও কাজে যেতে পারছে না। পড়াশোনা শেষ বেকার থাকা লাগছে। তাই অভিভাবকরা মনে করছেন, কারিগরি শিক্ষা যদি দেওয়া যায় তাহলে কিছু একটা করতে পারবে, অন্তত বেকার থাকবে না। এজন্য কারিগরি শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।

‘অন্যদিকে ধর্মীয় শিক্ষার ধারাও এখানে দুটি। একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আওতায় আলিয়া মাদ্রাসাগুলো, আরেকটি কওমি বা অন্যান্য শিক্ষার নিজস্ব পদ্ধতিতে। আমাদের ডাটা বলছে এবং আমরা পর্যবেক্ষণ করে জানতে পেরেছি, এখানে মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। এখানে কিছু কম্পিটিটিভ অফার আছে যেটা সাধারণ শিক্ষাই নেই। তাছাড়া এখানে তুলনামূলক খরচ কম। এজন্য অভিভাবকদের এখানে আগ্রহ বাড়ছে।’

কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেকগুলো কারণে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার মান উন্নত করা প্রয়োজন। এরমধ্যে বেকারত্ব দূরীকরণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আগামীতে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে মেডিক্যাল টেকনিশিয়ানসহ বিভিন্ন কারিগরি বিভাগে ৩০ লাখ লোক লাগবে। এরমধ্যে যদি আমরা কারিগরি শিক্ষার বিস্তৃতির মাধ্যমে দেশের জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারি তাহলে এটা অনেক বড় সুযোগ এনে দেবে বলে মনে করেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওই উপপরিচালক।




👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles