Sunday, October 19, 2025

তোমার গানের ওপারে


সন্ধের গা ঘেঁষে বসে আছি। ভরা শ্রাবণ। মাঝে মাঝেই বুকে চমক দিয়ে ডেকে উঠছে মেঘ। পুকুরঘাট থেকে শোনা যাচ্ছে মত্ত দাদুরীর ডাক। একটা গানের সুর ভিজতে ভিজতে আমাদের মাটির দাওয়ায় উঠে এলো। পাশের বাড়ির রূপু দিদি গান গাইছে হারমোনিয়ামে— ‘তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ।’ সেই গান যেন আমার শরীর মনের মর্মে পৌঁছে গেল। আমার শরীরের উদ্ভাসে জাগছে প্রেম। যদিও সেই কিশোরীবেলায় প্রেম কী তেমনভাবে বুঝিনি। তবু এক অপার ভালোলাগায় ডুবে যাচ্ছিলাম। আমার দুই বিনুনি দুলে উঠছিল সুরের কাঁপনে। মনের মাধুরী ছাপিয়ে তখন আকাশ ঝরছে। কোথায় আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছি।

সেই যে বুকের অতলে জেগে উঠল রবিঠাকুরের গান, সেই শুরু। রূপু দিদি গেয়ে চলেছে— ‘ওগো দুখজাগানিয়া’— অমনি কোমল গান্ধার অভিমানে চিক চিক করতে করতে আমার বুকে ব্যথা বাজিয়ে তুলল! কী আশ্চর্য সুর! এ গান এর আগে শুনিনি। তাও মনে হচ্ছে কত চেনা। প্রথম পঙক্তি রূপু দিদি বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে, সেই অপূর্ব সুর মেঘের তল বেয়ে ভিজতে ভিজতে আমার হৃদয়ে আছড়ে পড়তে লাগল। ‘এল আঁধার ঘিরে’ বলার পর যখন সুর পঞ্চমে আশ্রয় পাচ্ছে মনে হলো একমুঠো করুণ বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে ঘন আঁধারে। এক নিবিড় ব্যথায় আরও গাঢ় হয়ে উঠছে আকাশের কালো। সুরে সুরে বিন্দু বিন্দু হাহাকার ঝরে পড়ছে! মন্দ্র সপ্তক থেকে সুরের কোমলতা চারিয়ে যাচ্ছে মধ্য সপ্তকে। পরে ধীরে ধীরে বিরহের চলাচল ধৈবত ও পঞ্চমে। তার আড়ালে ‘ব্যথা’ কাঁদছে। আকাশ ধীরে ধীরে সুরের শুদ্ধতায় শান্ত হয়ে আসছে। সুর গান্ধার থেকে কোমল গান্ধারে এসে নিজেকে সমর্পণ করে দিচ্ছে সুরদেবতার কাছে। নিভে আসছে সুর। আমার কিশোরী মন তখন প্রবল আনন্দের তীব্রতায় কেঁদে উঠছে। পার্থিব জগৎ থেকে কোন অশেষ তখন আমাকে টানছে। এই-ই কি আত্মনিবেদন?

এই প্রশ্নটা পরে অনেকগুলো শ্রাবণ পেরিয়ে এসে নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছি। আসলে সেদিনের সেই সুরের বিভা আজও আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। সেই ‘দুখজাগানিয়া’ এখনও আমাকে ডাক দিয়ে চলেছে। এখনও মনে হয় সেই শুদ্ধ মধ্যম আমাকে ছুঁয়ে। রবীন্দ্রনাথ এভাবে আমার জীবন সমগ্র তাঁর গানের কোমল গান্ধারে বেঁধে রেখেছেন। সত্যি কথা বলতে কী রবীন্দ্রনাথ একাধারে যেমন মহাপ্রজ্ঞাবান, অন্যদিকে তাঁর ব্যাপ্তি অপরিমেয়। এই যে তাঁর গান আজও আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে এ কী কম কথা! তাঁর এই গান আমার কাছে ব্যথারও অধিক, চির অনিবার্য হয়ে থাকল। এ প্রসঙ্গে একটা কথা আমার বলতে ইচ্ছে করছে— রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সংরাগের বিচিত্র রূপের মাঝে ‘গীতবিতান’ এক মহাবিস্ময়। যেখানে থাকা অজস্র গান আমাদের বিস্ময়ে বিহ্বল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাঁর গান হলো অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাঁর গানের বাণী, সুর, আমাদের জীবন, সত্তা, বিশ্বাস, ভালোবাসাকে যেভাবে জড়িয়ে আছে তা কি কয়েকটি শব্দে বোঝানো যায়? তা যে একান্ত অনুভবের বিষয়।

‘তোমায় গান শোনাব’—এই গানটি সেই কিশোরীবেলায় যেভাবে আমার হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল তাকে কি আজ উপড়ে ফেলতে পারব? সেদিনের সেই আনন্দ, বিষাদের মহাজগতে আজও ঘুরপাক খেয়ে চলেছি। আর একটি বিষয় আমাকে ভাবায়—রবীন্দ্রনাথের গান বোঝার জন্য দারুণ বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাঁর গানের সুর এমনই যে আপামর বাঙালি অবাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এ বিষয়টি তিনি নিশ্চিত বুঝেছিলেন। সেজন্যই তাঁর গান যেমন সাধারণের জীবনের ব্যাকুলতা, প্রেম, শান্তির সঙ্গে জড়িয়ে তেমনি আবার গুণী মানুষের অন্তরের আকাশ অবধি ব্যাপ্ত।

আমরা সাধারণ মানুষ, সংকীর্ণ আমাদের দৃষ্টি। তাঁর গান, তাঁর ভাবনাকে স্পর্শ করা, অনুভব করার ক্ষমতাই বা কতটুকু? কোন ছোটবেলায় সেই গান শুনেছিলাম, সেই গানের প্রথম পঙক্তির কাছে আজও আমি বাঁধা। রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যাপ্তি আমার বোধের আকাশ পেরিয়ে আজও আমাকে স্পর্শ করে আছে। সেই গানের মূর্ছনার কাছে আমার জীবন দাঁড়িয়ে রইল। তাকে পেরিয়ে যেতে পারলাম না। তাঁর গানের সেই অলৌকিক আলো আমার জীবনের অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগে ছড়িয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে যাবে এমনভাবে। আরও অনেক ভরা শ্রাবণের সন্ধেবেলা এই আশ্চর্য গানের কাছে বসে থাকব। আর তাঁর গানের ওপার থেকে তিনি আমাকে দেখবেন। তাঁর ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়বে স্পর্শাতীত এক স্বর্গীয় হাসি।




👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles