Saturday, June 28, 2025

আমিই মুক্তিযোদ্ধা, আমিই রাজাকার | মতামত


শিরোনাম আপাতদৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক মনে হলেও, এটা মোটেই সাংঘর্ষিক না। কি ঘটে গেল এই প্রজন্মের মধ্যে? প্রবীণরা তাদের বুঝতে পারছে না! প্রবীণদের মতো চিন্তা করে এমন অসংখ্য তরুণের মনেও একই প্রশ্ন। এখানে হচ্ছেটা কী? যারা আন্দোলনে নেমেছেন তাদের মধ্যেও দ্বিধা। কারও মতে এই স্লোগান কোনোভাবেই দেয়া যাবে না, আবার কারো মতে এটাই উৎকৃষ্ট স্লোগান। 

যা ঘটছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন নয়। মহাভারতের পিতামহ ভীষ্মের ধর্মপরায়ণতা সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু সময়ের চোখে তিনি সবচেয়ে অধার্মিক হয়ে গেলেন। কৃষ্ণ এসে জানান দিলেন, দীর্ঘদিনের অপচর্চায় পরম্পরাও অধর্ম হয়ে যায়, আমগাছের মতো। যখন এটা চারা তখন এটাকে কেউ স্বীকার করে না। যখন এটা বৃক্ষ হয় তখন পূজাও দেন অনেকে। যখন ফল ধরে তখন ভোগের জন্য কাড়াকাড়ি শুরু হয়। যখন সে ফল পুরনো হয় তখন পচে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ফল নিয়ে আমরা প্রচুর কাড়াকাড়ি করেছি। এতা কাড়াকাড়ি করেছি যে এটাকে পচিয়ে ফেলেছি। সেই পচা দুর্গন্ধের স্তূপে দাঁড়িয়ে কখনও মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান মুখে আসবে না কারো। 

ফরাসি বিপ্লবকে আমরা এক সময় মনে করেছি এটাই সব প্রগতির ভিত্তি। মার্ক্সবাদীরাও তাই মনে করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের মনে হয়েছে এই বিপ্লব অসম্পূর্ণ। ফলে তারা রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে এই বিপ্লবকে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন। অসম্পূর্ণ রুশ বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করেছে চীনের বিপ্লব। এ ভাবে যুগে যুগে বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব এসেছে, পৃথিবী প্রগতির পথে এগিয়েছে। কোনো জাতি দীর্ঘদিন এক জায়গায় পড়ে থাকলে তার পিছিয়ে পড়া নিশ্চিত। সেকেন্ড নেপোলিয়ন প্যারিসের ক্ষমতা দখল করেছেন মাত্র। কিন্তু তার ভাতিজা থার্ড নেপোলিয়ন যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি নিজেকে চাচার মতো প্যারিসের সম্রাট ঘোষণা করেননি, ফরাসি জাতির সম্রাট হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার হাত দিয়ে শুরু হলো ফরাসি জাতীয়তাবাদ। এর চূড়ান্ত অপব্যবহারের ফলও তিনি পেয়েছেন। 

মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সেটার চূড়ান্ত ব্যবহার আমরা ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থপাচারের মতো কাজেও করেছি। সরকারী দলের লোকেরা করেছে, বিরোধীদলের লোকেরা করেছে, এমনকি বাসার পিয়নটা পর্যন্ত বাদ যায়নি। আজকে প্রশ্নফাঁসকারী আবেদ আলীর মতো ব্যক্তিরাও নিজেকে ‘মুজিব সৈনিক’ পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে অন্তত এক যুগ। মুজিব কোট পরা কোনো ব্যক্তির প্রতি যেনো আঙুল তোলা যাচ্ছে না। যেমনটা আঙুল তোলা যায় না ধর্মের পোশাকধারীদের উপর। যখন সব কিছু প্রায় ভেঙে পড়তে যাচ্ছে, তখন আমরা এদের চিনতে শুরু করেছি। সরকার, প্রশাসন, দুদক কি বেনজির আর মতিউরদের বিষয়ে কিছুই জানত না আগে থেকে? আমারা ধারণা করতে পারি, ঠিকই জানত। মুখ খোলেনি। তাদের মাধ্যমে দলের নেতারাও সুবিধা পাচ্ছিল। 

সততাই যে সবচেয়ে বড় শক্তি এটা ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। কয়েকটা তাজা প্রাণ ঝরার মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলন এক সময় শেষ হয়ে যাবে হয়ত। হয়ত তাদের সংলাপে ডাকা হবে, কিছু কোটা কমবেও। কিন্তু যেদিন জনগণ তাদের অন্য সকল ন্যায্য অধিকারের জন্য রাস্তায় নামবে সেদিন কী হবে? ইতিহাস বলে, পরম্পরা সব মেটান্যারেটিভ একদিন ভেঙে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের যে মেটান্যারেটিভ ছিল তা ভেঙে যেতে বসেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে সাম্যের সমাজ গঠনের কথা ছিল তা গঠন না করে উল্টো বৈষম্যের সমাজ বিনির্মাণ করা হচ্ছে। সময়টাই আসলে এখন এমন, পূর্বের সকল প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে প্রশ্ন করার। যা কিছু প্রতিষ্ঠিত আছে তার সব কিছুই প্রায় নষ্টদের দখলে চলে গেছে। তাই সব কিছুকেই প্রশ্ন করে দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে যারা রাষ্ট্র গড়তে চায়, যারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যারা ইসলামি খেলাফত কায়েম করতে চায় এরা প্রত্যেকেই প্রশ্নবিদ্ধ আজ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ঋণখেলাপি, সমাজতন্ত্র চর্চার নামে ব্যক্তিতন্ত্রের চর্চা, ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে ইসলামি ব্যাংকে দুর্নীতি, কর্মীদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এগুলো জনগণের চোখে আজ স্পষ্ট। সব প্রতিষ্ঠিত মেটান্যারেটিভ আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

কবি কামরুজ্জামান কামু বলেছেন:
‘আমি সন্ত্রাসী আমি ধর্ষক আমি ধর্ষিত নারী
আমি তোরই ছেলে বুকে তুলে নে মা ফিরেছি নিজের বাড়ি
হৃৎপিণ্ডের ঢিপঢিপ ধ্বনি চঞ্চল রক্তের ফিনকির মতো 
ছিটকে বেরিয়ে দেহে ফিরে আসি ফের
করি লেফট রাইট গুম করি আর গুম হয়ে যাই নিজে।’

এমন স্ববিরোধী বক্তব্য শুধু এ সময়ে কামুই দেননি। কাজী নজরুল বলেছেন, ‘আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস’। ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার তার ‘দ্য ফ্লাওয়ার্স অব ইভিল’ কবিতায়ও এমন স্ববিরোধী কথা বলেছেন। তিনি কবিতায় বলেছেন, ‘আমিই জল্লাদ, আমিই ফাঁসির আসামী। আমিই চাকু, আমিই ক্ষত।’ এ সবই আসলে সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের প্রয়োজনে আমি মিক্তিযোদ্ধা, সময়ের প্রয়োজনে সেই আমিই রাজাকার।

আজ যারা মাঠে আছে এদের কেউই সেই অর্থে ‘রাজাকার’ নয়। এটা একটা ক্রোধের ভাষা, আয়রনি। তরুণ প্রজন্ম আয়রনির আশ্রয় নিয়েছে। আমরা জানি, আয়রনিতে যা বলা হয় তার উল্টোটা বুঝে নিতে হয়। এতটুকু অ্যালিগেরি বোঝার বোধ যদি আমাদের না থাকে, তবে তো আরও ধ্বংস অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমাদের ভরসা রাখা উচিত এই তারুণ্য অন্তত বিভ্রান্ত নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গভীরভাবে ধারণ করে। তারা একাত্তরের রাজাকারদের ধ্বংসযজ্ঞ যেমন জানে, তেমনি জানে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সব গুঁড়িয়ে দিতে হয়। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন যারা জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদের কীভাবে সম্মান দিতে হয়। তার মতো কোনো সরকার প্রধান এতো সম্মান দিতে পারেনি ইতিপূর্বে। তাই বলছি, কোটাপ্রথা সম্পূর্ণ বাতিল না করে, ছাত্রদের বিভক্ত না করে, তাদের দাবি অনুযায়ী কোটা সংস্কার করুন। এখানে ইগোর কিছু নেই। তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায়নি। ইতোপূর্বে যে সকারগুলো ছিল তারাও কোটাপ্রথা কমাতে পারেনি। সুতরাং এখানে বাহাদুর কেউ নেই। বহাদুর হওয়ার বরং এখনই সময়।

যেহেতু এই সময়টাই হলো প্রশ্ন করার, সেই জায়গা থেকে এই আন্দোলনকেও অন্তত একবার প্রশ্ন করা উচিত। কেনো তারা চাকরিতে ঘুষের বিরুদ্ধে না লড়ে কোটার পেছনে লেগেছে সর্বপ্রথম। যখন স্লোগান দেয়া হয় ‘কোটা না মেধা, মেধা, মেধা’ তখন শুনে মনে হয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা প্রিলি আর রিটেন পরীক্ষা ছাড়াই ভাইভাতে চলে যায়! যেখানে প্রশ্নই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কথা না বলে আমরা কোটা সংস্কারকারীরা প্রথমেই মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছি কেনো? আমরা জানি, এটা স্পষ্টতই সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। কারণ, এই বীরের দেশে কোনোদিন এতো রাজাকার পয়দা হতে পারে না। তবু খতিয়ে দেখতে হবে আন্দোলনের প্রথম সারিতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের কেউ আছে কিনা। কারণ, এই আন্দোলনের নেতাদের কেউ দুধে ধোয়া তুলসি পাতা না। 

আমরা দেখেছি, আগের আন্দোলনের বড় নেতা এখন বিকাশ নেতা হিসেবে পরিচিত আমাদের কাছে। আমাদের মধ্যে কেউ ফ্যাশন হিসেবে আন্দোলনে যাচ্ছে কিনা। এইসব প্রশ্ন করাও সময়ের দাবি। এসব প্রশ্ন না করতে পারলে এই আন্দোলন অসম্পূর্ণ, সে নিজেও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নের পরই বুঝতে পারবো আমরা আসলে সত্যিকার অর্থে রাজাকার নাকি মুক্তিযোদ্ধার দলে। প্রশ্ন করার সময় দিলে কোনো মায়া রাখলে চলবে না। সেই ফরাসি স্ববিরোধী কবি শার্ল বোদলেয়ার তার বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য ফ্লাওয়ার্স অব ইভিল’ এর প্রথম ছত্রেই বলছেন-
‘‘আমি ক্রোধ ছাড়াই তোমাকে আঘাত করব
এবং ঘৃণা ছাড়াই, কসাইয়ের মতো।
মুসা যেমন পাথরে আঘাত করেছিল
আর তোমার চোখের পাতা থেকে
আমি তৈরি করব কষ্টের জল
যা আমার সাহারাকে প্লাবিত করবে।’’

আমাদের বিশ্বাস তরুণ প্রজন্মও প্রশ্ন দিয়ে নিরন্তর আঘাত করবে এবং সত্য আবিষ্কার করে প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে বারবার আসবে।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা




👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles