Friday, February 7, 2025

ময়লা সরালেও আবার আগের চেহারায় ফিরে যায় খাল


বছর না পেরোতেই আবারও পুরনো চেহারায় ফিরে গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের খালগুলো। ময়লা আবর্জনার স্তূপে একেবারে বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশাল ভূমিকা রাখার কথা এই খালগুলোর, কিন্তু আবর্জনা জমে সেখানে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহই বন্ধ। যার ফলে বর্ষা শুরুর আগে হালকা বৃষ্টিতেই পানি জমে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে করপোরেশনের আওতাধীন কাজলা খাল, মাতুয়াইল কবরস্থান খাল, মৃধা বাড়ি খাল, শ্যামপুর খালের ২৪ ফুট রাস্তার সম্মুখ প্রান্ত থেকে মোহাম্মদী ব্রিজ পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়। শ্যামপুর খালের ২৪ ফুট রাস্তার সামনের প্রান্ত থেকে বটতলা পর্যন্ত, শাজাহানপুর ঝিল থেকে বাসাবো কদমতলা শুকনগর খাল, মান্ডা খালের শুকনগর থেকে শাপলা ব্রিজ হয়ে আমিন মোহাম্মদ ব্রিজ পর্যন্ত, স্টাফ কোয়ার্টার থেকে ডগাইর সাংবাদিক বাড়ি খাল, সুখনগর-নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী (জিরানি) খালে এবং জিয়া সরণি খালে বিশেষভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালানো হয়। কিন্তু বছর না পেরোতেই আবারও মানুষের ফেলা ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে খালগুলো।

সরেজমিনে দেখা যায়, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯টি খালের সবকটিতেই কমবেশি আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে শুরু করে দোকানপাটের বর্জ্য সবকিছু স্থান পেয়েছে এসব খালে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে এগিয়ে যেতেই পথে পড়ে কাজলা খাল। ময়লার স্তূপের কারণে এই খালে পানি প্রবাহ বন্ধ। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে রাজধানীতে হওয়া বৃষ্টির কারণে এই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরেও জলমগ্ন ছিল এলাকাটি। কারণ এখানে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক পথ নেই।

যাত্রাবাড়ী সংলগ্ন কুতুবখালী খাল

পলিথিন, প্লাস্টিক, ভাঙা চেয়ার, ছেঁড়া কাপড়, তোষক, বাঁশের চাটাই কী ভাসছে না ওই খালে। মাতুয়াইল ও মৃধা বাড়ি খালেরও একই অবস্থা। এই খালের পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ ময়লার গন্ধে নাক চেপে ধরতে হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা সোহানুর জানান, বাসা বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি এসে খালের পানিতে পড়ে। ময়লার স্তূপ জমে থাকায় খালের পানি প্রবাহ বন্ধ। যার জন্য পয়োবর্জ্য আর ইউরিনের গন্ধে মানুষকে এখান দিয়ে হাঁটার সময় নাক চেপে হাঁটতে হয়।

বাসাবো কদমতলা শুকনগর খালের অবস্থাও শোচনীয়। দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানিতে মরা কুকুর, পলিথিন-প্লাস্টিকে একেবারে বাজে অবস্থা সেই খালের। সেখানকার বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, কয়দিন আগে এখানে গাড়ি এক্সিডেন্টে একটা কুকুর মারা গেছে। দুদিন ধরে পড়ে ছিল, সিটি করপোরেশনের লোকেরা নেয় নাই। পরে এখানকার কয়েকজন কোনোরকমে খালের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিছে। খালে পানিতে স্রোত না থাকায় ওটা ওখানেই পড়ে আছে। এজন্য চারপাশে গন্ধ ছড়াচ্ছে।

মৃধা বাড়ি খাল

শ্যামপুর খাল ও নন্দীপাড়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জিরানি খাল দেখে বোঝার উপায় নেই এই দুটো খাল নাকি ময়লার ভাগাড়। দূর থেকে মান্ডা খাল দেখতে একটা সবুজ মাঠের মতো।

অবশ্য শ্যামপুর, জিরানি, মান্ডা ও কালুনগর খাল পুনরুদ্ধারের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে সঠিক সময়ে এই কাজ শেষ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।

নন্দীপাড়ার বাসিন্দা আতাউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শুনেছি খাল সংস্কার আর দখলমুক্ত করার অভিযান শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এদিকে এখনও কোনও কাজ করতে দেখিনি। খাল দখলমুক্ত করতে পারবে কিনা এ নিয়ে সংশয়ে আছি।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনেক খালের জমি কমবেশি দখলে চলে গেছে উল্লেখ করে এই বাসিন্দা আরও বলেন, যারা খাল দখল করেছে তারা সবাই স্থানীয় প্রভাবশালী। সিএস (ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে) এবং আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) ম্যাপ অনুযায়ী দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উচিত সবগুলো খালে নতুন করে সীমানা চিহ্নিত করা। সীমানা চিহ্নিত করে দখল হয়ে যাওয়া খাল মুক্ত করতে পারলে খাল আরও বেশি প্রশস্ত হবে। তখন পানির স্বাভাবিক প্রবাহের সমস্যাটা কমবে।

কোন আবর্জনা নেই মৃধা বাড়ি খালে

খাল বা পানি প্রবাহের মধ্যে সাধারণ মানুষ যেন কোনও ধরনের ময়লা আবর্জনা না ফেলে সেজন্য তাদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, জনগণকে সচেতন করার নানান উপায় আছে। যদি তাতেও কাজ না হয় তাহলে প্রয়োজনে শাস্তি বা জরিমানার ব্যবস্থা করে হলেও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এতে করে তারা নিজেরাই সুফল ভোগ করতে পারবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক মো. সেলিম মৃধা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পাবলিকের ফেলা ময়লা এবং সুয়ারেজ লাইন থেকে আসা ময়লা জট বেঁধে আছে। আমরা কিন্তু বারবার নিষেধ করি। এরপরও কেউ আমাদের কথা শুনছে না। সুয়ারেজ লাইনে বা খালে ময়লা না ফেলতে আমরা মাইকিং করে নিষেধ করেছি। তবুও কেউ আমাদের কথায় কর্ণপাত করেনি।

মাতুয়াইল কবরস্থান সংলগ্ন খাল পাড়

কাজলা খালে ময়লা আবর্জনা ফেলার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে প্রত্যেক ঘরে ঘরে ময়লার জন্য লোক যায়। কিন্তু এখানকার বাসিন্দারা মাত্র ১০০ টাকা ময়লার বিল না দেওয়ার জন্য তাদের বাসা বাড়ির ময়লাগুলো খালের মধ্যে ফেলে। আমরা তাদের বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা আমাদের কথা শোনে না। সিটি করপোরেশন থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে খাল পরিষ্কার রাখার  জন্য। কিন্তু জনগণ যদি সহযোগিতা না করে তাহলে তো সম্ভব না। ডিএসসিসি মেয়র নিজে এসে এখানকার বাসিন্দাদের খালে ময়লা আবর্জনা না ফেলতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কেউ কথা শুনেনি। এখনও দেদার ময়লা ফেলছে। তার ফল অবশ্য ভোগ করছে। ঝড়-বৃষ্টির এক সপ্তাহ পরেও এখানে জলাবদ্ধতা থাকছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‌ দক্ষিণ সিটির আওতাধীন খালগুলো পুনরুদ্ধার করে সেখানে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যে চারটি খালের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। কাজও চলমান রয়েছে। এই ধারায় সবগুলো খাল দখলমুক্ত ও আধুনিক করা হবে। খালের বর্জ্য ও পলি অপসারণ করে বাইসাইকেল লেন ও অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, এম্ফিথিয়েটার ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে। এছাড়াও বসার বেঞ্চ, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, আরসিসি রিটেনিং ওয়াল ও সুরক্ষা ঢাল নির্মাণ, দৃষ্টিনন্দন সুরক্ষা বেষ্টনী ও পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করবে সিটি করপোরেশন।

ধোলাইপাড় সংলগ্ন কুতুবখালী খাল

খাল থেকে বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ বাংলা ট্রিবিউন জানায়, গত বছরের জুলাইয়ে দক্ষিণ সিটির ৯টি খাল থেকে ৩ দিনে ১ হাজার ১৭ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রায় ১ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী এই কার্যক্রমে অংশ নেন। তখন খালগুলো সুন্দরভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন যেহেতু আবার ময়লা হয়েছে, আবার পরিষ্কার করতে হবে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সবগুলো খালকে শ্যামপুর, জিরানি, মান্ডা এবং কালুনগর খালের মতো দৃষ্টিনন্দন ও দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে।

এদিকে গতবছর কিছু অংশে বর্জ্য অপসারণ করা শ্যামপুর ও জিরানি খালসহ মান্ডা এবং কালুনগর খালের নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ৮৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মান্ডা খালের জন্য ব্যয় হবে ৩৯৭ কোটি টাকা। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এই চারটি খাল পুনরুদ্ধার করে আধুনিকায়ন করা হবে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

জামিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসার পাশে অবস্থিত কাজলা খাল

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বাকের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ধাপে ধাপে সব খাল পরিষ্কার ও আধুনিকায়নের কাজ করা হবে। যে খালগুলোর কথা বলছেন তা কিন্তু পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন আবার যেহেতু মানুষ ময়লা ফেলে আবর্জনার স্তূপ করেছে আমাদের আবার পরিষ্কার করতে হবে। নয়তো ঠিকভাবে পানি নিষ্কাশন হবে না। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব যেমন খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, তেমনি রাজধানীবাসীর উচিত অযথা যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে সুনাগরিকের পরিচয় দেওয়া। মানুষ যদি দায়িত্বশীল না হয় তাহলে তাদেরই ভোগান্তি পোহাতে হবে।

ছবি: প্রতিবেদক

আরও পড়ুন-

খালের সীমানা নির্ধারণে কতটা এগোলো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন?

খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?

কল্যাণপুরে হবে ‘হাইড্রো ইকোপার্ক’, কমবে জলাবদ্ধতা বাড়বে সৌন্দর্য

সুতিভোলা খাল উদ্ধারে তৎপর ডিএনসিসি, ‘বাধা’ স্থানীয়রা

সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিনোদন পার্ক করবে ডিএনসিসি




👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles