গো নিউজ২৪ | নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৪, ০৩:২১ পিএম আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৪, ০৯:২১ এএম
অপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার সিদ্ধান্ত কতটা ভুল হতে পারে, তার বড় উদাহরণ সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) পিএলসি। দেড় যুগ আগে দেশের দুটি বিপর্যস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে (বিএসআরএস) একীভূত করে গঠন করা হয়েছিল বিডিবিএল, যা ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে জনপ্রিয় গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলো।
বিএসবি-বিএসআরএস একীভূত হয়ে নতুন নামে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু পুরোনো খেলাপি ঋণের বোঝা বয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে দেওয়া ঋণও খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসাসফল হতে পারেনি; বরং ধুঁকছে খুব। ব্যাংকটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করার পরও এর কোনো উন্নতি ঘটেনি। এটি ব্যাংকিং ব্যবসার পরিবর্তে শেয়ার ব্যবসা ও ভবন ভাড়া বাবদ পাওয়া আয়ের ওপর নির্ভর করেই কোনোমতে টিকে আছে।
বিডিবিএলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একীভূত হওয়ার পর বাণিজ্যিক চরিত্রে ফিরে ‘আগ্রাসী ব্যাংকিং’ করার কারণেই মূলত প্রতিষ্ঠানটি দুর্দশায় পড়েছে। যে কারণে ঋণের ৪২ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। গত ডিসেম্বরের শেষে বিডিবিএলের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৯৮২ কোটি টাকা।
বিডিবিএলের এমন পরিণতির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান গাজী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকিং করার অভিজ্ঞতা না থাকায় একীভূত হওয়ার পরপরই বড় ভুল করে ব্যাংক। অন্যান্য ব্যাংক খারাপ গ্রাহকদের ঋণ দেয়, যা এখন ভোগাচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক হলেও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কোনো শাখা নেই। আর ব্যাংকটির আকারও বড় হয়নি। শেয়ারবাজারে বড় বিনিয়োগ আছে, যা এখন খারাপ হয়ে পড়েছে। ফলে আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। আমরা নতুন শাখা খুলে আমানত বাড়িয়ে ব্যাংকটিকে ভালো করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’
বিডিবিএলের আর্থিক অবস্থা
গত ২০১৮ সালে বিডিবিএলে মোট আমানত ছিল ২ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে কমে হয় ২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে অবশ্য আমানত বেড়ে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ও ২০২২ সালে ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকায় ওঠে। গত বছরের, মানে ২০২৩ সালে আমানত আরেকটু বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
২০১৮ সালে ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ঋণ বেড়ে হয় ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা ও ২০২২ সালে ২ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালে অবশ্য ঋণ কমে ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায় নামে।
২০১৮ সালে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪৬ শতাংশ বা ৮৮৯ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। তা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪২ শতাংশ। খেলাপি ঋণের ভয়াবহ এই সংকট কাটাতে ব্যাংকটি কমবেশি চেষ্টা করলেও পারছে না। ২০১৮ সালে ব্যাংকটির শাখা ছিল ৪৪টি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৫০।
জানা গেছে, বিডিবিএল ২০২২ সালে ঋণ দিয়ে ও আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করার পর যে পরিমাণ আয় করেছে, তার প্রায় দ্বিগুণ এসেছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ থেকে। ওই বছরে ব্যাংকটির নিট সুদ আয় হয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা, অন্যদিকে শেয়ারবাজার থেকে আয় করেছিল ৭৫ কোটি টাকা। ওই বছরে ভবন ভাড়া থেকে আয় হয় ২০ কোটি টাকার মতো। ঢাকার মতিঝিল ও কারওয়ান বাজার এবং চট্টগ্রাম ও খুলনায় বিডিবিএলের বহুতল ভবন রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ঝিনাইদহ ও রাজশাহীতে মোট ২৭ বিঘা জমি রয়েছে। শেয়ারবাজারের ব্যবসা করার জন্য ব্যাংকটির বিডিবিএল সিকিউরিটিজ ও বিডিবিএল ইনভেস্টমেন্ট নামে পৃথক দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
আটকে গেছে যাদের কাছে
বিডিবিএলের মোট ৯৮২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২-৩ জন গ্রাহক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। অন্য গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া হয় বিডিবিএল গঠনের পর। এসব ঋণ বিতরণের পর খেলাপি হয়ে পড়ে, যা আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। বিডিবিএলের যাত্রা শুরুর কিছুদিন পর এতে এমডি হিসেবে যোগ দেন জিল্লুর রহমান। এই পদে তিনি পাঁচ বছর ছিলেন। বেশির ভাগ ঋণই তাঁর আমলে দেওয়া।
ব্যাংকটির প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে দেওয়া ঋণই এখন শীর্ষ ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এম এম ভেজিটেবল অয়েলের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১১০ কোটি টাকা। তাল্লু স্পিনিংয়ের খেলাপি ঋণ ৬৯ কোটি টাকা, আর আর স্পিনিং অ্যান্ড কটন মিলসের খেলাপি ঋণ ৬৫ কোটি টাকা, ডেলটা স্পিনার্স ও বিআর স্পিনিংয়ের খেলাপি ৪৭ কোটি টাকা করে। এ ছাড়া মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের খেলাপি ঋণ ৩৮ কোটি টাকা ও সোনারগাঁও টেক্সটাইলের খেলাপি ঋণ ৩০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান গাজী বলেন, ‘কয়েকজন শীর্ষ খেলাপি গ্রাহক ইতিমধ্যে কিছু কিছু টাকা জমা দিয়েছেন। আশা করছি, এসব ঋণ নিয়মিত হয়ে আসবে। এভাবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমবে।’
সূত্র: প্রথম আলো