Tuesday, October 14, 2025

ব্যাংক মানে বিশ্বাস | মতামত


ব্যাংক শব্দের সরাসরি কোনো অর্থ না থাকলেও বিশ্বব্যাপী ব্যাংক শব্দটি বিশ্বাসের প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। আদিকালে স্বর্ণকারদের ঘরে সিন্দুক ছিল বলে মানুষ বিশ্বাস করে তাদের কাছে টাকা-পয়সা বা সোনাদানা রাখত। অনেক সময় এসব টাকা-পয়সা তারা আর উঠিয়ে নিত না। অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে স্বর্ণকারের কাছেই জমা পড়ে থাকতো। এটা দেখে স্বর্ণকারগণ এসব গচ্ছিত টাকা সুদের বিনিময়ে অন্যদের কাছে ঋণ দিতে শুরু করে। যখন তারা বুঝতে পারল যে, এতে ভালো লাভ পাওয়া যায়, তখন তারা ঘোষণা দিয়ে বাজারে বেঞ্চ বা টুল বিছিয়ে টাকা লেনদেন করতো। এই বেঞ্চ থেকেই ব্যাংক শব্দের উৎপত্তি। 

এখন কেউ ব্যাংক বলতে আর বেঞ্চ বোঝেন না। সবাই ব্যাংক বলতে একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান বোঝেন। অনেকে বলে থাকেন, মানুষ তাদের স্ত্রী অথবা স্বামীর চেয়েও ব্যাংককে অধিক বিশ্বাস করেন। একজন মানুষের কত টাকা আছে বা কী পরিমাণ সম্পদ আছে তা তাদের স্ত্রী বা স্বামী না জানলেও ব্যাংকার জানেন। এমন যে বিশ্বাসের আধার বলে পরিচিত ব্যাংক, বাংলাদেশে কী তাকে আমরা পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছি?

দু’একটি ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বাংলাদেশে এই ফেরত না দিতে পারার চর্চা শুরু হয় ‘বিসিআই’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এটি ছিল একটি বিনিয়োগ কোম্পানি। এরাই বিজ্ঞাপনে লিখত, Financial institution on us. এখানে তারা ব্যাংক বলতে বিশ্বাসকেই বুঝাতো। বিসিআই-এর সাথে অন্য একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ‘এনসিএল’ও বিপদে পড়ে। কারণ তখন সবাই তাদের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে আসে। এ দুটো প্রতিষ্ঠান পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। তখন গ্রাহকগণ আবার তাদের বিশ্বাস করতে শুরু করে। কারণ আমানতকারীদের ধারণা ছিল যে, ব্যাংক মানে বিশ্বাস। ব্যাংকের তদারকীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

পরে সময়ের আবর্তে অনেকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান তহবিল নিয়ে আটকে যায় অথবা তাদের পরিচালকগণ টাকা লুটপাট করেন এবং ভুয়া ঋণ বিতরণ করে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বর্তমানে বেশ কটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আমানতকারীদের অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন।

অতি সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে দু’একটি ব্যাংকও গ্রাহকদের টাকা ঠিকভাবে পরিশোধ করতে পারছে না। এসব ব্যাংকের পরিস্থিতি দিনে দিনে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক- এদের চেয়ারম্যানদের চরম দুর্নীতির জন্যই রসাতলে গিয়েছে। সরকার বিভিন্ন উপায়ে, সরকারের আরও টাকা খরচ করে ব্যাংক দুটোকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এগুলোর তলা এতটাই ফুটো করে দিয়ে গেছে তাদের পূর্বসূরি চেয়ারম্যান ও বোর্ডের সদস্যগণ যে এখন কোনোভাবেই আর এগুলোকে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সেই সাথে কোনো অজ্ঞাত কারণে দোষী ব্যক্তিদের সাজাও দেওয়া হচ্ছে না।

কোনো কোনো ব্যাংকের করুণতম হাল হয়ে গেছে। কঙ্কালসার এসব ব্যাংককে অন্য স্বাস্থ্যবান ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের নাম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাহলে হয়তো জনগণ এসব ব্যাংকের কথা এক সময় ভুলে যাবে এবং এদের কলঙ্কও অতলে তলিয়ে যাবে। আমরা পুরনো ইতিহাস মনে রাখি না। টাকা হারানোর শোকও মানুষ এক সময় ভুলে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে বা চাপে অনেকগুলো ব্যাংক একীভূত হবে বলে শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক আপন করে নিচ্ছে পদ্মা ব্যাংককে। এক্সিম ব্যাংকের সে সামর্থ আছে; তারা একটি ব্যর্থ ব্যাংকের সকল দায় কাঁধে নিয়ে চলতে পারবে। কিন্তু পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে তারা কাবিননামায় স্বাক্ষর করলেও তা যে খুশি মনে এবং আনন্দচিত্তে করেনি তা বেশ বোঝা যায়। তাহলে কেন বলা হচ্ছে যে, উভয় পক্ষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যৌথ সংসার গড়ে তুলছেন? অনেকেই বলে থাকেন, এ ঘটনাটিতে যিনি বা যারা ঘটকালি করেছেন তারা মুরুব্বি লোক, তাদের কথা শুনতে হয়। এখন মুরুব্বির কথা শুনে চরম ব্যাধিগ্রস্থ ব্যাংকের সাথে গাটছড়া বাঁধতে দ্বিধাগ্রস্থ তারা। অবশ্য এটাই হওয়া স্বাভাবিক।

বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা আর্থিকভাবে বেহাল অবস্থায় পড়লে সরকার এই দুটো প্রতিষ্ঠানকে এক করে দিয়েছে; নাম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল। নিজের নামের সঙ্গে ডেভেলপমেন্ট যুক্ত করেও নতুন প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের ভাগ্য ডেভেলপ করতে পারেনি। ফলে এই ব্যাংকটিকে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন একটি বড় ব্যাংক একই মালিকের অধীন অন্য একটি ছোট ব্যাংককে পেটের ভেতর ধারণ করতে পারবে সহজেই। এতে সোনালী ব্যাংকের জন্যে কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি হবে না। এরূপ মিলনের ফলে সরকারের কোনো আর্থিক ক্ষতি নেই। কারণ আগে যে ভর্তুকিটুকু বিডিবিএল নামে প্রদান করতে হতো এখন তা সোনালী ব্যাংকের নামে দিতে হবে। অথবা বিডিবিএল-এর লোকসান সোনালী ব্যাংকের লাভ (যা শেষ অবধি সরকারের কোষাগারে জমা হতো) থেকে সমন্বিত হবে।

কথা হচ্ছিল দি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক হতে আলাদা হয়ে যাওয়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) আবার এক সাথে মিলে যাবে। কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাকাবের মিলে যাওয়ার কথা দীর্ঘদিন থেকেই আলোচিত হয়ে আসছিল। এর অবশ্য প্রধান কারণ ছিল যে, কৃষি ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের টাকা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে পাঠাতে পারে না; আবার রাকাবও গ্রাহকের রেমিট্যান্স অন্য বিভাগগুলোতে পাঠাতে পারে না। এই আলোচনা বর্তমানে যখন চূড়ান্ত রূপ নিতে যাচ্ছে তখন রাকাব তাদের অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। তারা কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে মিশে যেতে চায় না। যারা এই অনিচ্ছার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা হয়তো ভাবছেন যে, রাকাব বিলুপ্ত হয়ে গেলে তারাও নিজেদের পদবি হারাবেন। 

এদিকে বেসিক ব্যাংক সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ঘোষণায় নিজেদের অনিচ্ছা ব্যক্ত করে উর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বেসিক ব্যাংক একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক। এখানে শত অনিয়ম করেও চাকরিতে বহাল থাকা যায়, পদোন্নতিও হয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের আধুনিক ডিজিটাল ধারার ব্যাংক হিসেবে পরিচিত সিটি ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। তখন তাদের চাকরি থাকবে না। অফিসার কর্মচারীদের যে কোনো দুর্বলতা বা অনিয়মের কারণে সিটি ব্যাংকে চাকরি চলে যাওয়া একটি নৈমিত্তিক বিষয়। দীর্ঘদিন হতেই সিটি ব্যাংক এরূপ অপসারণের চর্চা করে আসছে। নিজেদের আপন লোকের বেলাতেই যেখানে চাকরিচ্যুতির বেলায় সিটি ব্যাংক অনড়, সেখানে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেলায় তাদের সদয় থাকার কোনো কারণ নেই। বেসিক ব্যাংক একটি প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে শুনে অনেকেই তাদের তহবিল সরিয়ে নিচ্ছেন। এতে বেসিক ব্যাংক অধিকতর তারল্য সংকটে পড়েছে।

পরিচালকদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ধুকতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা ছিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদ এতে রাজী হয়নি। তারা এক বছরের ভেতর ব্যাংকটিতে ইউটার্ন দেখাতে পারবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তারা যদি সিরিয়াস হন এবং এক বছরের ভেতর অন্তত উন্নয়নের নমুনা দেখাতে পারেন তাহলে তাদের অবশ্যই আমরা সাধুবাদ জানাবো। প্রথম প্রজন্মের এই ব্যাংকটির প্রতি অনেকেরই ভালোবাসা আছে এবং এটি বিলুপ্ত হয়ে যাক তা অনেকেই চান না। তবে কালিয়াচাপড়া চিনিকল বন্ধ করার ঘোষণা আসার পর সরকারের কাছে এক বছর সময় প্রার্থনা করে, এক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে লাভে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে, শেষ বছর হিসেবে সবাই মিলে চূড়ান্ত দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানোর মতো ঘটনা এখানে না ঘটলেই রক্ষা।

দুই বোতল পঁচা পানি বড় এক বোতলে ঢাললে নতুন বোতলের পানি পঁচাই থাকে, পরিশোধিত হয় না। এক কলসি ভালো পানির সঙ্গে এক চামচ পঁচা পানি মেশালে কলসির পানিও বিশুদ্ধ থাকে না; তবে এক কলসি পানির সঙ্গে সামান্য খারাপ পানি পড়ায় সহজে এটা ধরা যায় না। তাই সময়ের আবর্তে সবটুকু পানিই পরিশুদ্ধ পানি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে কী হয় তাই এখন দেখার বিষয়। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, সমস্যা জর্জরিত ও দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানের বেলায় একীভূতকরণ কোনো সমাধান নয়। ব্যাংকগুলোর তহবিল নিয়ে যারা জোচ্চুরি করেছে, যারা ঋণ গ্রহণ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপী হয়ে সমাজে প্রচণ্ড দাপট নিয়ে চলছে তাদের কোনো বিচার না করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো একীভূত করার চেষ্টা জনগণের চোখে একটি রঙিন চশমা পরিয়ে দেয়ারই নামান্তর। এতে ব্যাংকের সমস্যা কমে যাওয়ার বদলে আরও বাড়তে পারে।

বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দূর করতে হলে দন্ত ও নখরবিহীন বাংলাদেশ ব্যাংককে অধিকতর শক্তিশালী ও যোগ্য করে তুলতে হবে। ব্যাংক মালিকদের নির্দেশে সার্কুলার ইস্যু করার নীতি ভুলে যেতে হবে। অর্থনীতির স্বার্থে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হলে চলবে না। আর সরকারকেও সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করার মানসিকতা নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে যারা অন্যায়ভাবে ব্যাংকের টাকা লুটপাট করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চাপে নিস্পেষিত জনগণ সুদিনের অপেক্ষায় আছে।

লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক




👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles