সম্প্রতি দুই মেয়ের হেফাজত নিয়ে বাবার করা রিভিশনের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি বিবেচনায় জাপানি দুই শিশুকে ভাগ করা হয়েছে’ বলে অভিমত দিয়েছেন বিচারপতি মামনুন রহমানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আদালতে বাবা ইমরান শরীফের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আখতার ইমাম, রাশনা ইমাম, নাসিমা আক্তার ও রেশাদ ইমাম। এরিকো নাকানোর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি ও মোহাম্মদ শিশির মনির।
জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো নাকানো ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান জাপানি আইনানুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে তিনজন সন্তান জন্ম নেয়।
তারা হলো- জেসমিন মালিকা শরীফ, লাইলা লিনা শরীফ ও সানিয়া হেনা। তিন মেয়ে টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসজেআই) শিক্ষার্থী ছিল।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইমরান তার স্ত্রী এরিকোর সঙ্গে ডিভোর্স আবেদন করেন। এরপর ২১ জানুয়ারি ইমরান স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু তাতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাব নাকচ করে। পরে স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান তাদের বড় দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
ওই ঘটনার চারদিন পর ২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর মধ্যে ২৮ জানুয়ারি এরিকো টোকিওর পারিবারিক আদালতে তার সন্তানদের জিম্মার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়ে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেন। ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন।
এদিকে, একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট নেন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
পরে ছোট মেয়ে সানিয়া হেনাকে মায়ের কাছে রেখে ১৮ জুলাই এরিকো শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন।
তিনি ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলেন উচ্চ আদালত। কিন্তু ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর হাইকোর্ট একই সালের ২১ নভেম্বর দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেন। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সাথে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন শিশুদের মা নাকানো এরিকো। পরে গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়ে কার জিম্মায় থাকবে, তার নিষ্পত্তি হবে পারিবারিক আদালতে হবে এবং তার আগ পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের কাছেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেন আপিল বিভাগ। তাই আপিল বিভাগ থেকে মামলাটি পারিবারিক আদালতে আসে।
শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান শিশুদের জিম্মা চেয়ে বাবা ইমরান শরীফের মামলা খারিজ করে রায় দেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে পরদিন ইমরান শরিফ আপিল করেন জেলা জজ আদালতে। ১২ জুলাই জজ আদালতেও ইমরান শরীফের আবেদন খারিজ করে দেন। তারপর তিনি হাইকোর্টে রিভিশন করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার সে রিভিশন আংশিক মঞ্জুর করে রায় দেন হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতের রায় থেকে উদ্ধৃত করে হাইকোর্ট বলেন, জেসমিন তার মায়ের সাথে এবং লায়লা লিনা তার বাবার কাছে থাকার পরিষ্কার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। এই কোর্টও তাদের দুইজনের সাথে আলাদাভাবে কথা বলেছেন এবং তারা একই ধরণের ইচ্ছা পোষণ করেছেন। লিনা বলেছে-কোনো অবস্থাতেই সে বাবাকে ছেড়ে যাবে না। বাবার সাথে থাকা বর্তমান বাড়িতে সে সন্তুষ্ট। বাবা তাকে পরিপূর্ণভাবে যত্ন নিচ্ছে। ভবিষ্যতের জন্য একসাথে থাকার গুরুত্ব বিবেচনায় এক শিশু থেকে আরেক সহোদর শিশুকে আলাদা করা কঠিন। সকল বিষয়, মানসিক অবস্থা ও শিশুদের অবস্থা বিবেচনা করে হেফাজতে দেওয়া হয়। মেয়ে লায়লা লিনা শরিফ সম্পর্কে এটি স্পষ্ট যে তিনি তার বাবার সাথে থাকতে অনড়।
এ সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে উচ্চ আদালত বলেন, আমার অভিমত এই যে, লায়লা লিনা শরীফের মামলাটিকে ব্যতিক্রমী মামলা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং মানসিক অবস্থা ও চরম ইচ্ছার কথা বিবেচনা করে এই সন্তানের হেফাজত প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত পিতার হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে।
দুই সন্তানের সঙ্গে বাবা মায়ের সাক্ষাতের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, উভয় পক্ষকেই (পিতা ও মাতা) নিজেরাই শিশুদের পরিদর্শনের (সাক্ষাতের) পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
রায়ের আদেশ অংশে আদালত বলেন, জেসমিন মালিকা শরীফের হেফাজত মায়ের পক্ষে নির্ধারণ করা হবে, তবে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি বিবেচনা করে কন্যা লায়লা লিনা শরীফের হেফাজত প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাবার কাছে থাকবে।
১৩ ফেব্রুয়ারি রায়ের পর শিশির মনির বলেন, তাদের তিনজন মেয়ে সন্তান আছে। তার মধ্যে প্রথম জন জেসমিন ও ছোটজন সোনিয়া মায়ের কাছে থাকবে। যে কোনো স্থানে যে কোনো সময় আনা নেওয়া যাবে। দ্বিতীয় সন্তান লায়লা বাবার কাছে থাকবে। তিন সন্তানের সাথে বাবা মা যে কোনো সাক্ষাত করতে পারবে। তবে দুই পক্ষই আপিল করার কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসএস