Monday, October 13, 2025

বাংলা নববর্ষ ও বাঙালির সাম্প্রদায়িক চৈতন্যের পরিচর্যা


বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিয়ানা নিয়ে আমাদের রয়েছে অন্তহীন বিতর্কের সুদীর্ঘ ইতিহাস, দিন যত গড়াচ্ছে এই বিতর্ক তত প্রবল হচ্ছে এবং এর কোনো শেষ গন্তব্য রয়েছে বলে ধারণা করা ক্রমশই দুরূহ হয়ে পড়ছে। কেননা প্রত্যেকেই তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয়ের বিবিধ ব্যাখ্যা হাজির করছেন। ফলে বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিয়ানা নিয়ে এমন কোনো অবস্থান তৈরি হচ্ছে না, যেখানে দাঁড়িয়ে সম্মিলিতভাবে গাওয়া যেতে পারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। বাংলা নববর্ষ সর্বজনীন উৎসব হলেও পালনের প্রক্রিয়া নিয়ে মতবিরোধের নামে বাংলার বিরোধিতা ক্রমাগত প্রবল হয়ে উঠছে। এই অবস্থার অন্তর্নিহিত কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে নতুবা অদূর ভবিষ্যতে বাংলা নববর্ষই হয়ে উঠবে একটি সাম্প্রদায়িক উৎসব। বাঙালি সংস্কৃতিকে কেউ ‘হিন্দুয়ানি’ আখ্যা দিয়ে এর মুসলমানিকরণের নামে বর্জনের দিকে প্ররোচিত করছে, আবার বিপরীতে আরেক দল বাঙালি সংস্কৃতিকে ‘মুসলমানি’ আখ্যা দিয়ে এর হিন্দুয়ানিকরণের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এই দুই দলের সাধারণ সমস্যা হলো এরা সংস্কৃতি, হিন্দুত্ব, মুসলমানিত্ব কিংবা বাঙালিত্ব কোনো কিছু সম্পর্কেই ধারণা রাখে না।

এই বিভাজনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় আমাদের নিজেদের চেনার পথ ক্রমাগত অপরিচিত হয়ে যাওয়াকে। আমরা নিজেদের বিষয়ে অনেক বেশি অজ্ঞ হয়ে উঠেছি। চিলের কান নেওয়া গুজবে চিলের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছি, কানে হাত দিয়ে দেখার মতো সাধারণ বুদ্ধিটুকু এই প্রবল তথ্যের জোয়ারে আমরা ভাসিয়ে দিয়েছি। এর পরিণতি হচ্ছে পতনের একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও স্বাভাবিকতা। এই অবস্থা থেকে আমাদের বাঁচতে হবে, কেন বাঁচতে হবে সেটি বোধ হয় ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। আমাদের জানতে হবে নিজেদের সম্পর্কে, নিজেদের ভালো-মন্দ সম্পর্কে, ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে; কিন্তু কীভাবে নিজেদের সম্পর্কে জানবো? এখানে সংকট আরো ভয়াবহ, আমাদের ইতিহাস-দর্শন-শিল্প-সাহিত্য-অর্থনীতি-রাজনীতি সর্বত্র অপতথ্যের হট্টগোল। যাদের আমরা বুদ্ধিজীবি-শিক্ষিত-প-িত-মনীষী হিসেবে জানি তারাই মূলত আমাদের পথভ্রষ্ট করার পেছনে মূল কারিগর। আর বাঙালির ইতিহাস সে তো ভয়ানকভাবে বিকৃত হয়েই বসে আছে। তাহলে আমাদের পথ কোথায়? যেহেতু আমাদের বাঁচতে হবে অতএব আমাদের অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে উত্তরণের পথ। কেবল পুঁথিগত বিদ্যা ও মুখস্থ  বিদ্যায় পারদর্শী কোনো মনীষীর দেখানো পথকে স্বতঃসিদ্ধ মনে না করে যদি আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিয়ে জীবনকে বুঝতে শিখি তাহলে দেখা যাবে সব কিছুই পরিষ্কার।

বাংলার প্রাচীন বিদ্বানগণ বলে গেছেন ‘আত্মনং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানো। এই নিজেকে জানার প্রক্রিয়ারও রয়েছে বিস্তারিত বর্ণনা। তাই প্রথমেই আমাদের জানতে হবে আমরা কারা, কী আমাদের পরিচয়, পরিচয়ের কত স্তরভেদ আছে এবং সেসবের ভূমিকা। সমস্যা হলো বাংলা নববর্ষ, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ইত্যাদি বিষয়ে যখন আমরা তথ্য-উপাত্ত খুঁজতে যাই তখন দেখা যাবে প্রচুর অপতথ্য তথ্যের নামে আমাদের সামনে সাজানো আছে, সেখানেই নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা-অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়নের বিষয়। যেমন: বাংলা অঞ্চল একটি সুপ্রাচীন জনপদ। অথচ নামকরণ, ভূমিগঠন, অপেক্ষাকৃত পরবর্তী মানব বসতি, বহিরাগত নানা স্রোতের মিশ্রণের ভিতর দিয়ে এর মূল স্রোতের সংকরত্ব, সাংস্কৃতিক শিকরহীনতা ইত্যাদি অপযুক্তির মাধ্যমে এর গৌরবকে বিস্মৃত করে দেয়ার প্রচেষ্টা দীর্ঘকাল ধরেই চলমান। এসব অপপ্রচার আর যাই করুক বা না-করুক অন্তত আমাদের হীনমন্যতায় ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই অপতথ্য, ভুলতথ্য ও সর্বৈব মিথ্যাতথ্য প্রচারের প্রধান সারিতে আছেন আমাদের পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, যারা মূলত শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবি-দার্শনিক-শিল্পী-সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক-গবেষক নন, বড় জোর পশ্চিমা কোনো পণ্ডিতের অনুবাদক; তাদের মতামতের সংকলক ও প্রচারক অথবা অন্ধ অনুকারী। অনুবাদক, অনুসারী, অনুগতদের লিখিত তথ্যাবলীই এখনো বাংলা ভাষায় ইতিহাস হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এসব ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় বাংলা সম্পর্কে বহিরাগতদের দৃষ্টিভঙ্গি। এর প্রায় সবকিছুই জীবন বিচ্ছিন্ন, আগন্তুক এবং তাদের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের অভিপ্রায়ে লিখিত। জন-মানুষ ও তার মানসের পরিচয়হীন একপেশে কথকতা। তার ভিতরেও ছিন্নবিচ্ছিন্ন কিছু ঐতিহাসিক তথ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, নামকরণ এবং ভূমির নবীনতা তত্ত্বগুলো আসলে অন্তঃসারশূন্য (বাংলা নামের উৎপত্তি নিয়ে বহু বিতর্ক আছে কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীর নাম বদলে গেলে কি সেই জনগোষ্ঠী বদলে যায়? অথবা ভূমি গঠনকে যখন যুক্তি হিসেবে আনা হচ্ছে বাংলা অঞ্চলের সভ্যতার প্রাচীনতাকে খারিজ করার উদ্দেশ্যে, তখন সন্দেহ তৈরি হতে বাধ্য, কেননা আমরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানি যে এর ভূমি প্রস্তুত ছিল মানব সভ্যতার জন্মের আগেই)। 

মানব সভ্যতাই পৃথিবীর বয়সের তুলনায় অতি নবীন ব্যাপার এবং সেই নবীনতা সব সভ্যতার বিষয়ে প্রায় একই পর্যায়ে আছে। কাজেই বাংলা অঞ্চলকে আলাদাভাবে নবীন হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে এক ধরনের অবজ্ঞা, অজ্ঞতা এবং ষড়যন্ত্রই প্রকাশ পায়। বাঙালির জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল মানুষের আবির্ভাবের দিন থেকে। ভূ-তাত্ত্বিক আলোড়ন ও চঞ্চলতার ফলে বাংলাদেশ গঠিত হয়ে গিয়েছিল প্লাওসিন যুগে। হিমালয় পর্বতমালার উৎপত্তির ইতিহাস, বেঙ্গল বেসিন গঠনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বাংলাদেশের এই অঞ্চলে সুসভ্য জাতি বাস করত এ বিষয়ে বহু প্রমাণই দেয়া যায়। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে এ বিষয়ে বিতর্ক চলমান রয়েছে। এর ধারাবাহিতায় আমরা যদি বঙ্গাব্দকে দেখি তাতেও একই ধরনের চিত্র ভেসে উঠবে। ঋগবেদের ঐতরেয় আরণ্যকে ‘বঙ্গা’ শব্দটি পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থসমূহের প্রমাণে মনে হয় খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছরের গোড়ার দিকেই উত্তর-ভারতীয় আর্যসমাজ এ অঞ্চল সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং দাক্ষিণাত্যের মতো এ অঞ্চলকেও অবজ্ঞা ও কিছুটা ঈর্ষার চোখে দেখত তারা। মহাভারতের আদিপর্ব অনুযায়ী অসুর-রাজ বলির পাঁচ পুত্রের নাম থেকেই অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম ও পুন্ড্র প্রভৃতি রাজ্যের নামকরণ হয়েছে। ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামে এক প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থেও বাংলাদেশের ভাষাকে ‘অসুর’ জাতির ভাষা বলা হয়েছে। অসুর, দস্যু জাতীয় নানাবিধ তুচ্ছ অভিধায় বাংলাকে ঈর্ষা করার এবং এই অঞ্চলকে পরাজিত করতে না-পারার গ্লানি ঢেকে দেয়ার চেষ্টাটুকু আমাদের অবিদিত নেই। বাংলা সনের উৎপত্তি বিতর্কেও এর প্রভাব আমরা দেখতে পাই। অথচ আমরা দেখতে পাই না যে, গ্রাম বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনে এর কি বিপুল প্রভাব। কোনো বাদশাহী ফরমান অথবা দিন তারিখ ঠিক করে বাংলা সনের এমন সর্বব্যাপী জোয়ার তৈরি করা কি আদৌ সম্ভব? বিশেষত সারা বাংলার সমগ্র প্রত্যন্ত অঞ্চলে? 

সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ অনুযায়ী বৈদিক রাশিচক্রের প্রথম রাশি মেষ। মেষ মাসের নাক্ষত্রিক নাম বৈশাখ। এই সৌর বৈশাখ সৌরবর্ষের মুখ। তাই পয়লা বৈশাখ নববর্ষ। সূর্যসিদ্ধান্ত প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার একটি প্রমাণ। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতকে লিখিত এই গ্রন্থে সূর্যকে স্থির ধরে পৃথিবীসহ বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের ব্যাস, কক্ষপথ, পরিক্রমণকাল সংক্রান্ত বিভিন্ন গণনার বর্ণনা রয়েছে। পঞ্চম শতকের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির এটি রচনা করেছিলেন। ভারততত্ত্ববিদ আলবেরুনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব উল হিন্দ’-এ উল্লেখ করেছিলেন যে, প্রাচীন ভারতেবর্ষে যে কয়েকটি প্রধান অব্দ প্রচলিত ছিল তা হলো: শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ। এসব অব্দ সৌরবৎসরভিত্তিক। শকাব্দ হলো সবচাইতে বহুল ব্যবহৃত এবং ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র প্রচলিত। ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা এই অব্দ ব্যবহার শুরু করেছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহিরের (মৃত্যু ৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে) সময় বা তদপূর্ব কাল থেকে। ভারতীয় পঞ্জিকাকারগণ এখন পর্যন্ত তাদের গণনা কাজে শকাব্দ ব্যবহার করেন ‘প্রমাণ অব্দ’ হিসেবে এবং পরে নিজ নিজ পদ্ধতিতে রূপান্তর করে নেন। শকাব্দ গণনা শুরু হয়েছিল ৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ‘মহাবিষুব সংক্রান্তি’ বিন্দু অতিক্রমের সঙ্গে। সূর্যকেন্দ্রিক জ্যোতির্বিদ্যার ধারণা প্রাচীন ভারতবর্ষে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল মার্ক-েয় ও শ্রীবাস্তবের হাত ধরে, যাঁরা প্রথম ধারণা করেছিলেন যে পৃথিবী গোলাকার।

বাংলা সনের উৎপত্তি বিতর্কের অনেকগুলো অভিমুখ। বঙ্গাব্দ বিষয়ক প্রথম সমস্যা হলো এর নামকরণজনিত, প্রত্যেক বিতর্কেই দেখা যাচ্ছে সন-সাল-তারিখ এসব শব্দের উৎপত্তি থেকে এর সূচনা চিহ্নিত করার প্রবণতা রয়েছে, আরেকটি সমস্যা হলো এর বয়স অর্থাৎ যদি এখন ১৪৩০ হয় তাহলে এর সূচনা ১৪৩০ বছর আগে অথবা এটি হিজরি সনের সমবয়সী কিংবা রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে এর সৃষ্টি। বাংলা সনের মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। মাসের নামকরণের সঙ্গে রাশিচক্রের নক্ষত্রদের নাম জড়িত রয়েছে কেননা পূর্ণিমার চাঁদ রাশিচক্রের যে নক্ষত্রের উপর দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা দেখায় তার নাম অনুসারে মাসের নামকরণ করা হয়। যেমন: আমরা বৈশাখ সেই মাসকেই বলি, যে মাসে চাঁদ রাশিচক্রের বিশাখা নামক নক্ষত্রের উপর দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা দেখায়। এভাবে ‘জ্যেষ্ঠা’ নক্ষত্রের নাম জ্যৈষ্ঠ, ‘আষাঢ়া’র নামে আষাঢ় ইত্যাদি মাসের নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে মাসগুলোর মতো দিনসমূহের নামেও জ্যোতিষ শাস্ত্রের বিশেষ যোগ আছে। যেমন: সূর্য অর্থাৎ রবি, চন্দ্র অর্থাৎ সোম। বাকি পাঁচটি দিনের নামও চলমান জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ গ্রহের নামে। যেমন: মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি। সুতরাং সন-সাল-তারিখ দিয়ে যদি আমরা প্রমাণ করতে চাই এটা মুসলিম আমলের সৃষ্টি তাহলে বৈশাখ-জৈষ্ঠ-আষাঢ় দিয়ে বলা যাবে এটি হিন্দু আমলের তৈরি। এখানে পক্ষপাতটুকু পুরোপুরি ধর্মাশ্রয়ী। বাংলার এই এক দুর্ভাগ্য যে এর প-িতমহল এমন বিভাজনে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন এবং বাংলা ক্রমাগত শেকড়হীন হয়েছে। তারা হিন্দু অথবা মুসলিমের কৃতিত্ব খুঁজেছেন, মনে-প্রাণে হিন্দু-মুসলিম হয়েছেন; বাঙালি হওয়ার আকাক্সক্ষা অথবা বাঙালিকে আত্মস্থ করার মতো তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। যার ফলে বঙ্গাব্দের উৎপত্তি বিতর্কও অনেকটাই হিন্দু-মুসলিম বিতর্কে পর্যবসিত হয়েছে।

বঙ্গাব্দের সূচনা বিতর্কে অন্য একটি প্রধান দিক হলো ইউরোপীয় আদলে প্রমাণিকরণ প্রবণতা এবং এ কারণেই টেনে আনতে হচ্ছে প্রাচীন শিলালিপিতে বাংলা সনের উল্লেখ থাকা না-থাকার প্রসঙ্গ। নাথধর্মের অন্যতম পীঠস্থান ছিল অবিভক্ত দিনাজপুর তথা আজকের ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল মহকুমার গুরু গোরক্ষনাথ মন্দির। প্রাচীন এ গোরক্ষনাথ মন্দিরে দুটি বেলে পাথরের উৎকীর্ণ শিলালিপি পাওয়া যায়। যেখানে বাংলা তারিখের উল্লেখ রয়েছে। এই শিলালিপি সম্রাট আকবরের বহুপূর্বকালের; শিলালিপিটি এখন দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত। খনার বচনেও আমরা পাচ্ছি মাস-দিন-বর্ষ-তিথির সবই, যেমন:
‘জ্যৈষ্ঠেতে বিধবা হয় আষাঢ়ে ধনী। মৃতপত্যা শ্রাবনেতে ভাদ্রতে রোগিনী।
আশ্বিনেতে মৃতপত্যা হইবে কামিনী। কার্ত্তিকেতে ঋতুমতি স্বকুল-নাশিনী।
মার্গ শীর্ষে ঋতু হম্বলে হয় ধর্মশীলা। পৌষেতে হ’লে ঋতু রতিতে বিহ্বলা।
মাঘে পতিব্রতা নারী হলে ঋতুমতি। ফাল্গুনে হইলে ঋতু বহু পুত্রবতী।
মদনোন্মাদিনী হয় হ’লে চৈত্রতে। সুপ্রিয়া বাদিনী হয় ঋতু বৈশাখেতে।’

কিন্তু এসবে আমাদের চলে না, আমরা চাই অকাট্য প্রমাণ। সেই প্রমাণ এই অঞ্চলের দার্শনিক প্রমাণ নয়, সাধারণ যুক্তিবুদ্ধিকে অবহেলা করে দৃষ্টিকটুভাবে আমরা ছুটছি পশ্চিমা ধাঁচে প্রমাণিকরণের দিকে। বাস্তবতার অভিঘাতকে অবহেলার পরিণামে আমরা আমাদের অস্তিত্বকেই সংকটাপন্ন করে তুলছি। সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি নামের বদল ঘটতে পারে কিন্তু মূল বিষয়বস্তু তাতে বদলে যায় না। ইতিহাসেই এর হাজার হাজার প্রমাণ আছে অথচ বাংলা সন নিয়ে কথা বলার সময় আমরা এ বিষয়টি মাথায় রাখছি না। বাংলা সনের উৎপত্তির সাথে এর ভাষা, মানুষ এবং মাটির যোগ থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু আমরা অস্বাভাবিকভাবে এই মৌল পদার্থগুলোকে বেমালুম গায়েব করে দিচ্ছি। হরপ্পা মহেঞ্জোদারো, পান্ডুরাজার ঢিবি, উয়ারি বটেশ্বরসহ কিছু টুটাফাটা প্রমাণ (!) আমাদের বলতে চায় আমরা এই মাটির আদি মানুষ এবং ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষায় অসভ্য ছিলাম না। এখানে গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, মনোবিদ্যা, জোতির্বিদ্যা, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পের প্রচলন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ছিল।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, মধুর ভান্ডার আক্রান্ত এবং পরাস্ত হওয়ার ইতিহাসও কম নয়। বাংলাকে বুঝতে হলে শুধু পশ্চিমা আদলে প্রমাণ হলেই চলে না, কিছু কাণ্ডজ্ঞানেরও দরকার হয়। আমরা যদি প্রমাণ বিষয়টিকে তার প্রয়োজনিয়তা নিয়ে প্রশ্ন করি, তাতে দেখা যাবে প্রমাণের সঙ্গ অথবা আশ্রয় যুগে যুগে তাদেরই কাজে লেগেছে যাদের মালিকানার বোধ অথবা দখলিকরণ প্রবণতা প্রবল। প্রমাণের সাথে মালিকানার সম্পর্ক একেবারে সরাসরি। আপনি কোনো কিছু প্রমাণ দিতে পারলেন না তো তার উপরে সম্পূর্ণ অধিকার হারিয়ে ফেললেন (যতই বিষয় বা বস্তুটি আপনার হোক না কেন)। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের শাড়ি, ইলিশ, শীতল পাটি, রসগোল্লা, মসলিন ইত্যাদির মালিকানা স্বত্ব (জিআই) নিয়ে যা হচ্ছে তাতে আমরা বেশ বুঝতে পারি আমার বা আমাদের বলে কিছু নেই, সবার সামনে চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রমাণ। বেলে-দোআঁশ মাটির মননে আর পাথুরে-বরফের মননে একই ধরনের প্রমাণীকরণ তত্ত্ব কাজে লাগানো হচ্ছে। দুটো ভিন্ন প্রকৃতির আলাদা জগতের প্রমাণ-পদ্ধতি কি করে একই হতে পারে? এটা কি বাস্তবসম্মত? আর পদ্ধতিটি যদি হয় পাথুরে-বরফের উপযোগী তাহলে বেলে-দোআঁশের পরাজয় অনিবার্য। এই অনিবার্য পরাজয় আমরা ইচ্ছাকৃত মানছি নাকি আমাদের অজ্ঞতাই প্রধান? অথবা এই ভূগোলের বাইরে কোনো জায়গা থেকে আগত যে কোনো কিছুই অধিক সঠিক, ভালো, উত্তম ইত্যাদি ধরনের দাসত্ববৃত্তি-মানসের ফল? 

প্রশ্নগুলো আসা দরকার উত্তর যাই হোক না কেন। ইউরোপের প্রমাণীকরণের সাথে আমাদের মিলবে না, এই সাধারণ সত্যটি বুঝতে যত দেরি হবে উত্তরণের পথটিও ততটাই দূর থেকে দূর দিগন্তে মিশে যাবে। এইতো কিছুদিন আগে (১৭ মার্চ ২০১৮) রুমানিয়ার কনস্ট্যান্টিন রিলিউ নামক এক ব্যক্তি জানতে পেরেছেন তিনি মৃত। ২০ বছরের অধিক সময় তিনি তুরস্কে বাবুর্চির কাজ করে দেশে ফিরে জানতে পারেন যে তার স্ত্রী তাকে মৃত হিসেবে নিবন্ধন করে রেখেছেন। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে তিনি জীবিত। কিন্তু আদালত তার মৃত্যু সনদ প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে এবং ঘোষণা করে এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। রিলিউ এসোসিয়েট প্রেসকে দুঃখ করে বলেন, আমার কোনো আয় নেই এবং আমি কোনো কাজে যোগ দিতে পারব না, কেননা আমি মৃত হিসেবে তালিকাভুক্ত। ব্যক্তি সশরীরে উপস্থিত থাকার পরও আদালত রায় দিয়েছেন তার জীবিত থাকার বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ তাদের হাতে নেই, অতএব তিনি মৃত। এই হলো ইউরোপীয় প্রমাণীকরণ তত্ত্ব, যেখানে মৃত কাগজপত্র সজীব মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রামাণিক। কাজেই ইউরোপীয় পথ আমাদের নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘হউক না হউক, আমাদের ইতিহাসকে আমরা পরের হাত হইতে উদ্ধার করিব, আমাদের ভারতবর্ষকে আমরা স্বাধীন দৃষ্টিতে দেখিব, সেই আনন্দের দিন আসিয়াছে। আমাদের পাঠকবর্গকে লেথ্ব্রিজ সাহেবের চটির মধ্য হইতে বাহির করিয়া ইতিহাসের উন্মুক্ত ক্ষেত্রের মধ্যে আনিয়া উপস্থিত করিব; এখানে তাহারা নিজের চেষ্টায় সত্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি ভ্রমও সংগ্রহ করেন সেও আমাদের পক্ষে পর-লিখিত পরীক্ষাপুস্তকের মুখস্থ বিদ্যা অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেয়, কারণ সেই স্বাধীন চেষ্টার উদ্যম আর একদিন সেই ভ্রম সংশোধন করিয়া দিবে।’

বঙ্গাব্দের সুলুক সন্ধানেও আমাদের ইতিহাস গ্রন্থগুলো ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন ভাষার তাত্ত্বিক-গবেষকদের রচনার প্রতি অতি নির্ভরতার কারণে আমরা আসলে নিজেদের প্রতি দৃষ্টি ফেরাতে, নিজেদের অন্তরাত্মার স্পন্দন অনুভব করতে ভুলে গিয়েছি, ফলশ্রুতিতে আমরা ইতিহাস পাচ্ছি কিন্তু আমাদের পাচ্ছি না। বাংলা সন অথবা বঙ্গাব্দের বিষয়েও তাই ঘটেছে। নিষ্ঠাবান ইতিহাস চর্চার নামে যে খরখরে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তার কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই হয়তো ভাবছেন তাহলে আমি ইতিহাস কোথায় অথবা কীভাবে পাবো? ইতিহাস ঘটে যাওয়া ঘটনা অতএব অতীতকালের বিষয় এবং সুনির্দিষ্ট; আসলে কি তাই? নাকি বর্ণনাকারীর মানস, আনুগত্য, পরিকল্পনা, অবস্থান এসব বিষয়ের কারণে ইতিহাস বিভিন্ন রকম হয়? রাজার অর্থায়নে লিখিত ঐতিহাসিকের কি রাজাজ্ঞার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আছে? ইতিহাসের ফসিল কি আমাদের জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে নেই? আছে; কিন্তু তা খুঁজে বের করার মতো সহৃদয় গবেষকের অভাবই প্রকট। যার অতীত নেই তার ভবিষ্যৎ থাকার সম্ভাবনাও নেই, যার অতীত সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির দখলে এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তার ভবিষ্যৎ এর বাইরে কোথাও নেই। 

বস্তুত, প্রত্নোপলীয় যুগ থেকে নবোপলীয় যুগ পর্যন্ত কৃষ্টির ধারাবাহিকতা আমরা এই অঞ্চলে লক্ষ্য করি। প্রত্নোপলীয় যুগের পাথুরে অস্ত্রসমূহ আমরা বাঙলার নানাস্থান থেকে পেয়েছি। সেই সকল স্থানের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে- মেদিনীপুর জেলার অরগণ্ডা, সলদা, অষ্টজুরি, শহারি, ভগবন্ধ, কুকরাধুপি গিডনি, ঝাড়গ্রাম ও চিকলিগড়; বাঁকুড়ার কাল্লা লালবাজার, মনোহর, বন আসুরিয়া, শহরজোরা, কাঁকরাদাড়া, বাউরিডাঙ্গা, বিশিণ্ডা, শুশুনিয়া ও শিলাবতী নদীর প্রধান প্রশাখা জয়পাণ্ডা নদীর অববাহিকা; বর্ধমান জেলার গোপালপুর, সাতঘনিহা, বিলগভা, সাগরডাঙ্গা, আরা ও খুরুপির জঙ্গল। এছাড়া পাওয়া গিয়েছে বীরভূম ও পুরুলিয়ার কয়েকস্থানে (যথা হুরা) ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দেউলপোতায়। এর মধ্যে শুশুনিয়ার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কেননা এখানে আমরা মনুষের নির্মিত অস্ত্রের সঙ্গে পেয়েছি প্লাইস্টোসীন যুগের জীবের অশ্মীভূত কঙ্কালাস্থি। যেহেতু প্লাইস্টোসীন যুগেই নরাকার জীব থেকে প্রকৃত মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল সেহেতু আমরা অনুমান করতে পারি যে, মানুষের আবির্ভাবের দিন থেকেই বাঙলায় মানুষ বাস করে এসেছে। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে মোগলবাহিনীর কাছে বঙ্গের আফগান শাসক দাউদ কররানি পরাজিত ও নিহত হলে বঙ্গ আকবরের অধিকারে চলে আসে। এর বহু আগে থেকেই সন-তারিখ-মাস-বর্ষ-দিন গণনা এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। তবে এটা ঠিক যে, বঙ্গাব্দ নানা সংস্কারের ভিতর দিয়েই আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সম্রাট আকবরও তাঁর শাসনকার্যের সুবিধার্থে কিছু সংস্কার করেছিলেন। ভারতবর্ষের সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে সাধারণভাবে কাল, ঘটনাপঞ্জি এমনকি ইতিহাসের প্রতি এমন ঔদাসীন্য ছিল যাতে ঐতিহাসিক কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে (ইউরোপীয় ধরনে)। মার্ক্সের মতে রাষ্ট্রনৈতিক আকাশের ঝোড়ো মেঘ ভারতীয় সমাজের অর্থনৈতিক উপাদানের কাঠামো বদলাতে পারেনি। গ্রামীণ জীবনে বাংলা সনের সর্বব্যাপী প্রভাব এবং এর সঙ্গে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনের যোগ থেকেই বুঝতে পারা উচিত বাংলা সন এমনকি ১৪৩০ বছরের পুরাতনই নয়, অন্তত এর আরো অনেক আগে থেকেই ভিন্ন কোনো নামের আবরণে চলে এসেছে বর্তমান সময়ের স্রোতধারায়।

‘আত্মনং বিদ্ধি’ মন্ত্রে বলিয়ান হয়ে আবার আপাদমস্তক নিজেদের পরখ করা দরকার। নিজেদের ভুলে যাওয়া, নিজের কাছে নিজেরাই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ভালো উদাহরণ আমাদের বাঙালি সমাজ। নতুন বছরের শুরুতে নতুনভাবে নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় হলেই বছরটি হয়ে উঠতে পারে ফলপ্রসূ। সম্প্রতি বাঙলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে কিছু কুতার্কিকের আগমন ঘটেছে দৃশ্যপটে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির ঐক্যের প্রতীক নববর্ষকে যারা বিতর্কিত করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকার প্রয়োজন আছে। জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তির স্ফূরণকে একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীর ভয় পাওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ভীরু-কলহপ্রবণ-রুচিহীন-অলস-নষ্টস্বভাব ধরনের প্রচারণায় নববর্ষের প্রাণোচ্ছ্বল ঐক্যবদ্ধ উৎসব একটি বিপরীত বার্তা। সম্মিলিত সংস্কৃতির চর্চায় যে সৌহার্দবোধ বর্ষবরণের মাধ্যমে বাঙালি সমাজ অনুভব করে তা তাদের জীবনের অন্যান্য কর্মপ্রবাহেও রেখে যায় গভীর প্রভাব। কাজেই বর্ষবরণকে বিভিন্নভাবে বিতর্কিত করতে হবে। এই কূটকৌশল ষড়যন্ত্রকারীদের ভালোই আয়ত্তে আছে। বর্তমান তাত্ত্বিকতার জামানায় এসবের জন্য বিভিন্ন তত্ত্ব এবং তথ্যও মজুদ রয়েছে। উত্তরাধুনিক তত্ত্ববিশ্ব থেকে যার সহজ সমর্থন পাওয়া যায়। যুথবদ্ধতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া কিংবা কোনো সাধারণ সংযোগকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে নৈরাজ্যকর বিশৃঙ্খলা তৈরির তাত্ত্বিক পাটাতন উত্তরাধুনিকতায় প্রস্তুত রয়েছে।

নিটশের ভাবনাকে খুব মূল্যবান মনে করেন উত্তরাধুনিকেরা। কিন্তু নিটশে উত্তর-উপনিবেশবাদের প্রেরণা হতে পারেন না। কারণ আধিপত্যকামী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সম্মিলিত সংস্কৃতির শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের প্রেরণা খুঁজতে হবে ঐতিহ্যের মাঝে। জ্যাক দেরিদার ডিকন্সট্রাকশন সাবেক উপনিবেশে আত্মঘাতি হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় বলিয়ান। দেরিদার কাছে রচনাই আসল বস্তু, রচয়িতা বা লেখক এবং ক্ষমতার বিন্যাসে লেখকের অবস্থানকে গুরুত্ব দেন না তিনি। উত্তর উপনিবেশবাদী ভাবুকের কাছে রচনা ও লেখক দুটোরই গুরুত্ব আছে। লেখক কী বলেন তা যেমন জানতে হবে, তেমনি জানা দরকার তিনি কেন বলেন। রোলাঁ বার্থের মতো লেখক, ভাবুক বা ক্ষমতা প্রয়োগকারীকে আমরা লুকিয়ে ফেলতে পারি না। তার উদ্দেশ্য ও গতি-প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ ছাড়া সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। ক্ষমতার বিন্যাসে লেখকের অবস্থান না জানলে তার লেখার পেছনের রাজনীতিটা বোঝা যাবে না। তাহলে টেক্সট বা রচনার সার কথা অধরাই থেকে যাবে। এ জন্যই পশ্চিমের টেক্সটে দেরিদার বিনির্মাণ প্রয়োগ করলে ইউরোকেন্দ্রিকতা ভেঙে পড়ে।

একই কৌশল যদি আমাদের রচনায় প্রয়োগ করি তাহলে যেখানে পৌঁছাব তা আসলে উপনিবেশবাদী জ্ঞান ও তার বানানো সত্য। যার পেছনে আমরা রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলছি। দেরিদার তত্ত্বের প্রভাবে উদ্ভূত উত্তরাধুনিক ভাষাচিন্তায় শব্দের খেলা, শব্দ ব্যবহারের অফুরান স্বাধীনতা যা নৈরাজ্যও গড়তে পারে; ওখানে হেঁয়ালিপনা করার প্রবণতাও জোরদার। কিন্তু উপনিবেশী প্রভাব দূর করার জন্য ভাষায় আমাদের ঐতিহ্য বহনের সামর্থ্য ও দরদ থাকতে হবে; যে স্বাভাবিক সামর্থ্য নানাভাবে নষ্ট করা হয়েছে। কাজেই এখানে উত্তরাধুনিক ভাষাচিন্তা সরাসরি উত্তর-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। সুতরাং আমাদের খুব সতর্কতার সাথে বুঝতে হবে যে, একবার আমরা আধুনিকতার নামে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ করেছি, আবার যখন উত্তর উপনিবেশবাদী আখ্যানগুলো সামনে আসছে তখন নির্বিচার উত্তরাধুনিকতার নামে সেই একই অনুুকরণের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি কিনা। সহজভাবেই গ্রহণ-বর্জনের নীতি নির্ধারিত হতে পারে; আর তা হলো সার্বিক মঙ্গলময়তার ভাবনা। (সার্বিক মঙ্গলকেও যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে উসখুস করছেন আমাদের বক্তব্য এসব কুতার্কিকের উদ্দেশেই; যারা তর্কে আমোদিত হন, বিষয়ের সমাধানে নয়) সেই ভাবনায় আমরা পৌঁছাতে পারি নতুন বছরকে বরণের মতো সর্বজনীন সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেই। উত্তরাধুনিকতার দোহাই দিয়ে সকল মাইক্রো ন্যারেটিভকেও গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ হিসেবে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে তাতে ফাটল ধরাতে পারলে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদেরই লাভের যোগ আছে; তাই তাদের এ দেশীয় সেবাদাসদের মাধ্যমে যেসব ধুম্রজাল বিস্তার করা হচ্ছে তার বিষয়ে হয়তো বৃহত্তর বাঙালি সমাজ সচেতন নন। 

আফ্রিকান চিন্তাবিদ নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’-এ যেমন বলেছেন, সমষ্টিগত প্রতিরোধীদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র পরিচালনা করছে সেটা হলো সাংস্কৃতিক বোমা। এই সাংস্কৃতিক বোমার লক্ষ্য হলো মানুষের নিজেদের পরিচয়, নিজেদের ভাষা, নিজেদের প্রতিবেশ, নিজেদের সংগ্রামের ঐতিহ্য, নিজেদের ঐক্য, নিজেদের ক্ষমতা এবং সর্বোপরি খোদ নিজেদের ওপর থেকেই বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়া। নিজেদের অতীতকে অর্জনহীন এক পোড়োভূমি বলে পরিচয় করাতে চায় এবং মানুষের মধ্যে নিজ ভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতা লাভের স্পৃহা তৈরি করার প্রয়াসে থাকে এই সাংস্কৃতিক বোমা। যে সব জিনিস তাদের নয় বরং অন্যদের সেসবের সঙ্গে তাদেরকে একাত্ম করে দেখাতে চায়। যেমন: নিজেদের ভাষার বদলে অন্যদের ভাষা। যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল ও অচল এবং যা কিছু তাদের প্রাণের উত্থানকে রহিত করে দিতে পারে সেসবের সঙ্গেই তাদের একাত্ম করে দেখাতে চায়। এমনকি সংগ্রামের ন্যায্যতার বিরুদ্ধে তাদের মনে সন্দেহের বীজ বপণ করে দেয়। বিজয়ের সম্ভাবনাকে সুদূরপরাহত এবং হাস্যকর স্বপ্নে পরিণত করে দেয়। এই সাংস্কৃতিক বোমার ইপ্সিত ফলাফল হলো মানুষের মাঝে নৈরাশ্য, হতাশা এবং ব্যাপক মৃত্যু আকাঙ্ক্ষা। 

 নিজের সৃষ্ট এই পোড়োভূমিতে সাম্রাজ্যবাদ নিজেকে উপস্থাপন করে ত্রাতার আদলে। এই উদ্ধারকারী এবং কল্যাণকামীতার ভেকধারী মহলের কৌশল বহুবিধ; তারা আমাদের চিন্তার দৈন্যকে চিহ্নিত করে তা থেকে মুক্তির পন্থা বাতলে দেয়ার নামে আমাদের মগজের দখল নেয়, এর জন্যে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় ধর্ম। এভাবেই স্থানীয় সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বা আংশিক বিলুপ্তি সম্ভব। এর টিকে থাকা বৈশিষ্ট্য এবং প্রবলভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্যগুলো অবমূল্যায়ন এবং নিকৃষ্টরূপে দেখার প্রবণতা তৈরি করার কিছু প্রচারণা মেশিনের বিরুদ্ধে অসতর্ক হলেই বিপদ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যমে বুনে দেয় বিভেদের বীজ। এই বীজ তাদের প্রযত্নে লালিত পালিত হয়ে একদিন মহীরুহে পরিণত হবে। বিভেদ যত গভীর হবে ততই তাদের মোড়লীপনার সুযোগ প্রসারিত হবে। সুতরাং বর্ষবরণের মতো নির্দোষ আনন্দ বিনোদনেও তাদের খুঁজে বের করতে হবে ফাঁকফোকর। অসাম্প্রদায়িক এমন উৎসবেও বসাতে হবে সাম্প্রদায়িক আঁচড়। 

বর্ষবরণের অসাম্প্রায়িক সম্প্রীতি চেতনায় নিজেদের চিনতে হবে। নিজেদের সংস্কৃতি সঠিকভাবে চিহ্নিত না করতে পারলে অপরের জিবেই স্বাদ চেখে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। জানতে হবে কারা এই সংস্কৃতির শত্রুপক্ষ, তাদের উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি, কেননা এই ছদ্মবেশী জ্ঞানপাপীদের আসল রঙের উপর অনেকগুলো পরতের সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিকতার নামে আমরা কোথায় কোথায় নিজেদের বিরুদ্ধাচারণ করছি সেই বিষয়ে সতর্ক না থাকলে জাতীয় মুক্তির সম্ভাবনা সুদূর পরাহতই থেকে যাবে। কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এবং তাদের স্থানীয় অনুচরগণ হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। ফ্রাঞ্জ ফানোঁ যেমন বলেছেন, ‘জাতীয় সংস্কৃতির অতীত অস্তিত্বের দাবি শুধু সেই জাতিকে পুনর্বাসিতই করে না, ভবিষ্যৎ জাতীয় সংস্কৃতির আশাবাদের যৌক্তিকতাকেই শুধু প্রতিষ্ঠিত করে না, মানসিক ভারসাম্যের স্তরে তা ভূমিসন্তানদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও আনয়ন করে। উপনিবেশবাদ একটি অধিকৃত দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ওপর শাসন চাপিয়েই সন্তুষ্ট থাকে না; উপনিবেশবাদ একটি গোষ্ঠীকে কব্জা করে তাদের মস্তিষ্ক থেকে সমস্ত রূপরস ও সারবস্তু নিংড়ে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে না, এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী যুক্তি দেখিয়ে উপনিবেশবাদ নিপীড়িত জনগণের অতীত ইতিহাসের দিকে হাত বাড়ায়, তাকে বিকৃত করে, কলঙ্কিত করে এবং ধ্বংস করে।’ 

যখনই বাংলায় তার ভূমিসন্তানদের জাগরণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তখনই আগমন ঘটেছে প্রতারক, বলপ্রয়োগকারী, ষড়যন্ত্রকারী এবং তাদের তল্পিবাহকদের। তাদের ছদ্মবেশ এত নিখুঁত যে সরল সহজ সাধারণ মানুষ খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়েছে আর তৈরি হয়েছে নতুন নতুন বিভাজন। বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানমালা এসব বিভ্রান্তি এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক উৎসব। 




👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles