Wednesday, June 25, 2025

নাড়ির টানে বাড়ি এবং একটি প্রস্তাবনা


ট্রেনের ছাদে উঠেছে আবু বকর। তার সঙ্গে আরও অনেক মানুষ। সামনে, পিছনে ট্রেনের ছাদে নানা বয়সের মানুষ। মায়ের কোলে দুধের বাচ্চাও আছে। কী ভয়ংকর। এই মাত্র চলন্ত ট্রেনটি হঠাৎ দ্রুত ব্রেক কষে দাঁড়ালো। ট্রেনের ছাদে বসা মানুষগুলো অনেক কষ্টে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখলো। বাচ্চা কোলে বসে থাকা মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। অন্যরা যে যার মতো নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতেই ব্যস্ত। কিন্তু মায়ের ব্যস্ততা তার সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে। পরম মমতায় সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। ট্রেন যখন হঠাৎ বিকট শব্দ করে ব্রেক কষলো তখন ছাদ থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলেন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখা ওই মা। পাশেই বসে থাকা মানুষটি তার স্বামী, সেই স্ত্রী ও সন্তানকে জাপটে ধরে।

‘ও মাগো…’ বলেই চিৎকার দিয়ে সন্তানকে আরও জোরে বুকের মাঝে লুকানোর চেষ্টা করে মা। ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করে– ক‚… ঝিক ঝিক, ঝিক ঝিক…

দুই.

কমলাপুর রেলস্টেশনে অনেক মানুষের ভিড়। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে সবাই। ঈদে রেলের টিকিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখন অনলাইনের যুগ। বাড়িতে বসেই সবকিছু করা যায়। এইতো কয়েক বছর আগেও কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের একটি টিকিটের জন্য কী সংগ্রামই না করছে সাধারণ মানুষ। একটি টিকিটের আশায় রাতে কমলাপুর রেল স্টেশনে এসে কাউন্টারের সামনে জায়গা দখল করেছে।

দৈনিক পত্রিকা বিছিয়ে টিকিট কাউন্টারের সামনে ঘুমিয়েছে। এখন অবশ্য সে দৃশ্য দেখা যায় না। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কেনার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় রাতে টিকিট কাউন্টারের সামনে জায়গা দখল করার সেই লড়াই এখন আর নেই। তবে অনলাইন বোঝে না এমন মানুষের জন্য ট্রেনের টিকিট কেনা সত্যিই একটা কঠিন কাজ।

তিন.

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে। সড়ক পথের যাতায়াত নির্বিঘ্ন হওয়ায় নদীপথের আগ্রহে যেন একটু ভাটা পড়েছে। তবে এবারের ঈদে নদীপথে যাতায়াতের সেই ঐতিহ্য যেন ফিরে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন এতটাই শক্তিশালী যে মুহূর্তের খবর মুহূর্তেই পাওয়া যায়। ফেসবুকেই দেখলাম নদী পথে যাতায়াতের সেই ভিড়ের দৃশ্য। লঞ্চের নিচ তলায় জায়গা দখল করে পাটি বিছিয়ে শুয়ে, বসে যাতায়াতের আনন্দই যেন আলাদা, অন্যরকম। পাঁচ সদস্যের পরিবার লঞ্চে পাটি বিছিয়ে জায়গা দখল করেছে। পরিবারের একজন শিশু সদস্য ফুটবল নিয়ে মেতে আছে। এরকম আরও অনেক পরিবার লঞ্চের নিচতলায় পাটি বিছিয়ে জায়গা দখল করেছে। এক রাতের জার্নি। কেউ কাউকে চিনতো না। কিন্তু জার্নি শেষে নিশ্চয়ই পরিবারগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব হবে।

চার.

একটি রেল স্টেশনে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ১৫/২০ জন মানুষ বাদুড় ঝোলার মতো ঝুলে আছে। একটু পরেই একটি ট্রেন আসবে। এই মানুষগুলো ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে পারেনি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রেনের ছাদে উঠে বাড়ি যাবে। ট্রেন এলো। মানুষগুলো চরম ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠলেন। ট্রেনের ছাদে এত মানুষ উঠেছে যে, দাঁড়াবার জায়গাটুকুও নেই। আরেকটি স্টেশনে দেখা গেলো অর্থের বিনিময়ে মই দিয়ে ট্রেনের ছাদে মানুষ উঠানো হচ্ছে। নিরুপায় মানুষগুলো তবুও খুশি। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে পারবে এটাই শান্তি।

পাঁচ.

গাবতলীতে একটি বাসের কাউন্টারের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। সবাই ঈদে বাড়ি যাবে। কেউ কেউ তিন ঘণ্টা ধরে বাসের কাউন্টারে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। অধিকাংশরাই রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামের যাত্রী। বাস আসতে দেরি হচ্ছে তাই এই অধীর অপেক্ষা। একজন মহিলা যাত্রীকে প্রশ্ন করলাম- কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন? তিনি বললেন- প্রায় তিন ঘণ্টা।

এতটা সময়? বিরক্ত লাগছে না?

হ্যাঁ, একটু বিরক্ত তো লাগছেই। ঈদে এমন পরিস্থিতি হবে সেটা সবাই জানি। বাড়ি পৌঁছে গেলে এই কষ্টকে আর কষ্টই মনে হবে না। বাড়ি পৌঁছে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরবো, তখন সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।

ছয়.

একটি টেলিভিশনের খবরে দেখলাম একজন মহিলা জানালা টপকে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছেন। যাত্রীর এতটাই ভিড় যে তাকে জানালা টপকে ট্রেনে উঠতে হলো। টেলিভিশন চ্যানেলটির রিপোর্টার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এত কষ্ট করে বাড়ি যাচ্ছেন? গার্মেন্টস কর্মী সেই মহিলা উত্তর দিলেন, বাড়িতে আমার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আছে। তারা অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বাড়ি না গেলে ওদের ঈদের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই এই কষ্টকে কষ্টই মনে হচ্ছে না।

সাত.

ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার এমন আরও অনেক গল্প আছে। যারা শহরে চাকরি করেন, ব্যবসা করেন তারা বছরের দুই ঈদে বাড়ি যাবেন এটাই অলিখিত নিয়ম। বছরের অন্যসময়ে বাড়ি না গেলেও দুই ঈদে বাড়ি যাওয়ার তাড়া শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। ঈদে কেন বাড়ি যায় মানুষ? ‘নাড়ীর টানে বাড়ি ফেরা’ সংবাদপত্রের এই হেডলাইনটি খুব পরিচিত পত্রিকা পাঠকদের কাছে। নারী আর বাড়ি। ছন্দের কি চমৎকার মিল। পারিবারিক অটুট বন্ধন বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির সুমহান ঐতিহ্য। মন খারাপ হলেই বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে। ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে। আর তাই আমরা সুযোগ পেলেই বাবা-মায়ের কাছে ছুটে যাই। মায়ের কোলে মাথা রাখার মধ্যেও কি যে সুখ। বাবাকে জড়িয়ে ধরার মধ্যেও কি যে আনন্দ এটা বাঙালি ছাড়া আর কেউ অনুধাবন করতে পারে না। ঈদে মানুষ কেন বাড়ি যায় এর পেছনে আরও একটি কারণ আছে। সেটা হলো সরকারি ছুটি। ঈদের মতো এত লম্বা ছুটি আর কখনও পাওয়া যায় না। সে কারণে ঈদে বাড়ি ফেরার পরিকল্পনাও শুরু হয় অনেক আগে থেকেই।

আট.

এত কষ্ট করে যারা নাড়ীর টানে বাড়ি ফিরলেন তাদের প্রতি ছোট্ট একটি আরজি পেশ করতে চাই। যারা শহরে থাকেন তাদের নিয়ে গ্রামের মানুষের এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়। শহুরে বাবু গ্রামে এসেছেন, নিশ্চয়ই গ্রামের জন্য কিছু একটা করবেন। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। আবার এটাও সত্যিই শহরে থাকা মানেই সবাই ‘শহুরে বাবু’ একথা ঠিক নয়। সে কারণে সবার পক্ষে কাউকে আর্থিকভাবে সহায়তা করাও সম্ভব হয় না। তাই বলে আপনি মুখের হাসিটুকুও অন্যর মাঝে বিলিয়ে দিবেন না সেটা তো ভাবা যায় না। অনেকে আছেন ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে ফেসবুকেই মত্ত হয়ে থাকেন। অথচ একটু সচেতন হলেই আপনি, আপনারা শহরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামেও একটা উন্নয়নের পথরেখা তৈরি করতে পারেন। যখন গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন তখন নিশ্চয়ই গ্রামে একদল বন্ধুকে ফেলে রেখে এসেছিলেন। তারা কে কোথায় আছেন এই ঈদের ছুটিতে খোঁজ নিন। আপনার গ্রামে কি পাঠাগার আছে? না থাকলে পাঠাগার সৃষ্টির পরিকল্পনা নিতে পারেন। গ্রামের দুঃস্থ, অসহায় তরুণ-তরুণীকে খুঁজে বের করে তাদের লেখাপড়ার জন্য সম্ভব হলে আর্থিক সহায়তা করার উদ্যোগ নিতে পারেন। যে স্কুলে পড়েছেন সেই স্কুলের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে একবার হলেও দেখা করার শিডিউল তৈরি করুন। সম্ভব হলে প্রিয় শিক্ষকের জন্য ঈদ উপহার হিসেবে একটি পাঞ্জাবি বরাদ্দ রাখুন। একবার কল্পনা করুন তো পাঞ্জাবিটা পেলে প্রিয় শিক্ষক কতটা খুশি হবেন। বাবা-মায়ের পরেই প্রিয় শিক্ষকের অবস্থান এ কথা কারোই ভুলে থাকা উচিৎ নয়।

এবার আসি নিজের পরিবারের কথায়। বাবা-মা, ভাই-বোনের বাইরে চাচা-চাচি, খালা-খালু, ফুফা-ফুফু এই সম্পর্কের মানুষগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখুন। এরাও আমাদের পরিবারের অংশ। মানুষের দুইটি হাতের বাইরেও আরও একটি হাত আছে। সেটি হলো অজুহাত। ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত। প্রথম দুই হাত দেখা যায়। অজুহাত দেখা যায় না। সে কারণে আমরা অনেকে অজুহাতের আশ্রয় নেই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে না পারার ক্ষেত্রে নানা ধরনের অজুহাত দাঁড় করাই। এটা মোটেই ঠিক নয়।

এবার ঈদের খুশির সঙ্গে বাড়তি খুশি আর আনন্দ নিয়ে এসেছে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রেও গ্রামের তরুণদের নিয়ে একটা কিছু চমক দেখাতে পারেন। হতে পারে নববর্ষ পালনের জন্য একটি ছোট অনুষ্ঠান। গান, নাচ সবই থাকলো। পাশাপাশি দিতে পারেন কয়েকজন গুণী ব্যক্তিকে সংবর্ধনা। এলাকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী, শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা, শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়, শ্রেষ্ঠ গায়ক-গায়িকা ক্যাটাগরিতে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করতে পারেন। তাহলে নাড়ীর টানে বাড়ি ফেরার কষ্ট অনেক আনন্দে রূপ নিবে। হয়তো ভাবছেন, এই ঈদ কি আর এত কিছু করা সম্ভব? ঠিক আছে এই ঈদ না পারেন পরের ঈদের জন্য প্রস্তুতি নিন। আসল কথা হলো পরিকল্পনা।

এই ঈদ শুভকামনা সবার জন্য। ঈদ মোবারক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।

 

 

 

 



Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles