নারায়ণগঞ্জে গাজী টায়ারসের অবকাঠামো এখন রূপকথার ভূতুড়ে প্রাসাদের মতো; যেখানে দেখা গেল ছাই-ভস্ম, পোড়া লোহা লক্কড় আর নিখোঁজদের অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের। এদিকে গত ৫ অগাস্ট দফায় দফায় লুটপাট ও আগুন দেয়া হলেও ২৫ অগাস্ট বিকালে গাজী টায়ারসের কারখানাটি একেবারে অঙ্গার হয়ে যায়।
গাজী গ্রুপের মালিক সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর, তার স্ত্রী হাসিনা গাজী তারাবো পৌরসভার মেয়র। রাজনৈতিক আধিপত্য ও জমিজমা নিয়ে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পক্ষের বিরোধের কথা মাঝেমধ্যে সামনে এসেছে। গত ২৫ তারিখের আগুন দেয়ার ঘটনা কি রাজনৈতিক, নাকি জমি-সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষোভ থেকে, তা নিয়ে খাদুন গ্রামের কেউ-ই মুখ খুলতে চাইলেন না। তারপরও যাদের সঙ্গে কিছু কথা হলো, নিরাপত্তা সংকটের কারণে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না।
গ্রামবাসীর দাবি, ২৫ অগাস্টের সংঘর্ষে গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না। ওটা ছিল ‘রাজনৈতিক মারামারি’। তবে নিখোঁজদের সন্ধানে আসা মানুষজন বলছেন, বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী কারাখানার ভেতরে ঢুকতে চাইলে তাদের সঙ্গে আরেকটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়। সেদিন সেই ঘটনা দেখিছিলেন, এমন কয়েকজন বলছেন, তখন (রোববার বিকালের পর) এখানে প্রচুর লোকজন ছিল। আর এমন লুটপাট চলছিল যে রাস্তায় যানজটে আটকে পড়া বাসের যাত্রীরাও নেমে কারখানায় ঢুকে পড়ে।
তাদের ভাষায়- সন্ধ্যার দিকে গাজী টায়ার্সের কারাখানার সামনে রুপসী মোড় থেকে একটা আর বিপরীত দিক থেকে আরেকটা মিছিল আসার পর শুরু হয় মারামারি, শোনা যায় গুলির শব্দও।
নিজের ভাই হাকিম শেখের ছবি ও পরিচয়পত্র নিয়ে গাজী টায়ার্সের ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন চান মিয়া শেখ নামে এক ব্যক্তি। তার ভাই হাকিম ২৫ অগাস্টের সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ। পাশের পাকিজা টেক্সটাইল কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতকে পড়ছিলেন হাকিম।
হাকিমের সঙ্গে সেদিন সেখানে থাকা একজনের কাছ থেকে চান মিয়া শুনেছেন, রোববার সন্ধ্যায় হাকিমের কারখানা ছুটি দিলে সে বাসায় যাওয়ার পথে গাজী টায়ারের কারখানার গেটে দেখে মারামারি হচ্ছে। বিশাল মারামারি, এক পর্যায়ে শুরু হইল গোলাগুলি। এইসময় দৌড়াদৌড়ি শুরু হইলে আমার ভাইসহ অনেকে গাজীর গেট খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ে। তার সঙ্গে যে ছেলেটা ছিল সে আরেক দিকে দৌড় দেয়।
চান মিয়া বলেন, তারা সেখানে ঢুকে পড়ার পরপর যে দুই গ্রুপ মারামারি করতেছিল তাদের এক গ্রুপের কিছু লোকজন গেটটা লাগায় দিয়ে আগুন লাগায় দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো কারখানায় আগুন ছড়ায় পড়ে। পরে রাত ১১টা পর্যন্ত ওর ফোনে রিং বাজছিল কিন্ত কেউ ধরেনি।
গত কয়েক দিন ধরে ভাইয়ের খোঁজে কারখানার আশপাশেই ঘোরাফেরা করছেন চানমিয়া। তিনি বলছেন, স্থানীয় লোকরা বলছে- গাজী গ্রুপের মালিক না কি আশপাশের মানুষের অনেক জমি নিছে। তখন অন্য লোকরা কারখানায় ঢুকতে চাইলে মারামারি শুরু হয়।
সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক মিলন তিনিও বলেন, ওই দিন সন্ধ্যার সময় কারখানার সামনে পরপর দুটি মিছিল নিয়ে লোকজন এসেছিল। ওই দুই মিছিলের লোকেদের মধ্যেই মূল মারামারিটা হয়। ওই মিছিলের লোকদের চেনেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হুনছি তো তারা বিএনপি নেতাগো লোক। তবে তাগোর সব নেতাগো চিনি না।
কারখানা চত্বরে কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। কারখানার ফটকে লোকজনের ভিড়, তাদের অনেকেই এসেছেন নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে।
কারখানার ভেতরে সারিসারি পোড়া ট্রাকের পেছনে টেবিল পেতে বসে ছিলেন গাজী গ্রুপের তিনজন কর্মী। তাদের একজন আব্দুস সামাদ বলেন, ৫ তারিখ (অগাস্ট) যেদিন সরকারের পতন হয়, সেদিনই এই কারখানায় লুটপাট শুরু হয়। ৮ তারিখ পর্যন্ত চলে লুটপাট। জিনিসপত্র যে যা হাতে পাইছে নিয়া গেছে। ২৫ তারিখ গাজী সাহেব অ্যারেস্ট হইলে পরে মাইকিং কইরা পাশের খাদুন গ্রামের লোকজন কারখানায় ঢুইকা পড়ে। ওই গ্রামের কিছু লোকের সঙ্গে গাজী গ্রুপের জমি নিয়া ঝামেলা ছিল। কিছু দিন আগেই (চলতি বছর) এই কারখানার সীমানা বাড়ানোর জন্য পাশের গ্রামের কিছু জমি কিনে তাতে বালু ভরাট শুরু হইছিল। নতুন কেনা জায়গাটা টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল।
সামাদের ভাষায়- এই জমি নিয়েই বিরোধের জেরে জমির মালিক দাবিদার ব্যক্তিরা তাদের দখল বুঝে নিতে রোববার কারখানায় ঢুকে পড়লে শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় গণলুটপাট।
খাদুন উত্তরপাড়ার (খাঁ পাড়া) জামে মসজিদের ইমাম লুৎফর রহমান বলেন, জোহরের নামাজের আগে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে একদল লোক গাজী গ্রুপের দখলে থাকা ‘জমির মালিকদের’ জড়ো হওয়ার ডাক দেয়। তাদের সবাইকে রুপসি মোড়ে জড়ো হতে বলা হয়৷ মাইকে তখন বলা হয়, তারা গাজী গ্রুপের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করবেন কিন্তু কেউ যেন আগের মত (৫ আগস্টের ঘটনা) লুটপাট না করেন। সেই অনুরোধও করা হয় মাইকে।
গাজী গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, ছয়তলা ভবনটিতে মূলত রাবারের সঙ্গে উচ্চ চাপ ও উচ্চ তাপে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে মণ্ড বানিয়ে পরিমাণ অনুযায়ী ধাতব বা নাইলন ব্যবহার করে টায়ার তৈরি করা হতো। বড় বড় ট্যাংকে রাখা হতো তরল রাসায়নিক, যা রাবারের সঙ্গে মেশানো হত। সেখানেই বয়লারের সেটআপসহ বড় কনভেয়ার বেল্টও ছিল। আগুনে সবই পুড়েছে।
তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, লুটপাটের পর ওই ভবন ছাড়াও আশপাশের মালামাল রাখার গুদাম, গাড়ি ও যন্ত্রপাতির শেড, প্যাকেজিং শেড সবকিছু থেকে লুট করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কারখানা চত্বরের বাইরে নতুন দখলে নেওয়া জায়গায় বালু ভরার ভেকু মেশিনটিরও (এক্সক্যাভেটর) যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে সেটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।
কারখানা চত্বরে কথা হলো রূপগঞ্জ থানার এসআই দর্পণ ও এএসআই বায়েজিদের সঙ্গে। তারা বলেন, নিখোঁজের বিষয়ে থানায় কোনো তথ্য নেই। ফায়ার সার্ভিস থেকে কিছু তথ্য দেয়া হয়েছিল। এখন তারা তাকিয়ে আছেন উদ্ধার অভিযানের দিকে।
তিন বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে ১০ বছরের ছেলের হাত ধরে গাজী টায়ার কারখানার ফটকে দাঁড়িয়েছিলেন রোজিনা খাতুন। তার স্বামী আল আমিন গত রোববার রাতে এক বন্ধু রাকিবের সঙ্গে ওই কারখানার ভেতরে ঢুকেছিলেন। এরপর থেকে আর খোঁজ নেই। রোজিনা বলেন, আমি ঘরে থাকি, ঘরেই কাম করি, রাস্তাঘাটও চিনি না। এহন কার কাছে গিয়া স্বামীরে ফিরায়া দিতে কমু, কার কাছে বিচার চামু হেইডাও জানি না।
কোলের কন্যা সন্তানটি যখনই বিরক্ত করছে তখনই রোজিনা বলছিলেন, চুপ কর, আব্বায় আইতাছে জুস নিয়া।
রং মিস্ত্রী শামীমের খোঁজে এসেছিলেন তার কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন। শামীমের স্ত্রীর বড় ভাই আবু হানিফ বলেন, “রবিবার রাত থিকা ওর ফোন বন্ধ। আমরা কয়দিন ধইরা ঘুইরা ঘুইরা হয়রান। পুলিশ, প্রশাসনের কেউ কিছু কয় না। পরে ওর ভাই আইসা পোড়া বিল্ডিং থিকা মাটি নিয়া চইলা গ্যাছে। আর আমি এহনো রইছি, যদি পাওয়া যায়।”
গত সোমবার স্বজনরা এসে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের কাছে নিখোঁজদের ও পরিবারের সদস্যদের নাম-ঠিকানা জমা দিয়েছিলেন, যেন খোঁজ পেলে তাদের জানানো হয়। কিন্তু পরে ফায়ার সার্ভিস সেই তালিকার বিষয়টি অস্বীকার করে।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা কারখানার ফটকের সামনে নিখোঁজদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেন। তারা নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে তালিকাভুক্ত করছেন। তারা ১২৫ জনের নাম স্বজনদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বলে সাংবাদিকদের তথ্য দিয়েছেন।
বাংলাদেশ জার্নাল/আরএইচ
👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com