Friday, June 27, 2025

শিক্ষার্থীদের ট্রমা মোকাবিলায় চাই রাষ্ট্র ও সমাজের জরুরি ভূমিকা


শিক্ষার্থীদের জন্য যে আদর্শ পরিবেশ আমরা কল্পনা করি তা যেন আজ অনেকটা অলীক স্বপ্নের আকারেই রয়ে গেছে। কেননা এখনও শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা কারণে নানানভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৮-২২ জুলাইয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহতদের মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল শিক্ষার্থী। অনেকের প্রাণ ঝরে গেছে আবার অনেকে হাত, পা কিংবা চোখ হারিয়েছে। ফলে তাদের সহপাঠীরা জানবে তাদেরই এক সহপাঠীর মৃত্যু ঘটেছে, দেখবে আশেপাশে অনেকেই হয়তো হাত বা পা হারিয়েছে কিংবা অন্ধ হয়ে গেছে।

যে শিক্ষার্থীকে শিক্ষক পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করতে শিখিয়েছিলেন,  সে জেনে গেছে রক্তের রঙও রঙিন। শিক্ষার্থীরা দেখেছে তার পরিবারের কেউ নির্মম মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে, যা তাদের মানসিক উন্নয়নকে ব্যাহত করতে পারে।

যখন কোনও দেশে রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটে এবং এতে শিক্ষার্থীরা নিহত হয়, তখন এটি বেঁচে থাকা সকল শিক্ষার্থীর ওপর গভীর মানসিক আঘাত তৈরি করে। এই ধরনের ঘটনার কারণে শিক্ষার্থীর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, আতঙ্ক, এবং হতাশা দেখা দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ যে গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে তাতে আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রমা সৃষ্টি করেছে এবং আগামীতে তার রেশ আরও চলবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এটি মোকাবিলায় আমাদের জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করি।

প্রথমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪-১৮ বছর বয়সের যে সীমা রয়েছে তা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং বয়স, মানসিকতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভেদে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ট্রমার ধরন ও মাত্রা বুঝে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ট্রমা মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

ট্রমা চিহ্নিতকরণে ও প্রতিকারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও গবেষণার ফলাফলকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা দেখতে পাই যে আমেরিকার প্রখ্যাত শিশু মনোবিশ্লেষক এরিক এরিকসনের দেওয়া সাইকোসোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট থিওরি (ক্রাইসিস রেজোলিউশন) প্রধানত কৈশোরসহ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক সংকট সমাধানের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।

তার মতে, ট্রমা শিক্ষার্থীর আত্মপরিচয় এবং সমাজে তার যে ভূমিকা হওয়া উচিত সেটির বিকাশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। তাছাড়া তাকে আবেগিক ও মনোজাগতিক সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। এই তত্ত্ব অনুসারে, ট্রমা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমরা যা করতে পারি–

শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুনরায় বিশ্বাস ও আস্থা জাগিয়ে তোলা জরুরি। পারস্পরিক মর্যাদা ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে সংকট হয়েছে তা নিরসনে শিক্ষার্থীদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস ও তাদের অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে।

একটি সুন্দর সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া তৈরিতে পরিবার এবং শিক্ষাবিদদের জোর দিতে হবে।

পূর্বের সাম্য অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নতুন ইতিবাচক অভিজ্ঞতা সৃষ্টিতে মনোযোগী হতে হবে। তাতে শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে ও ট্রমাকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা সৃষ্টি হবে।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ট্রমা মোকাবিলায় সমাজ ও রাষ্ট্র যেসব ভূমিকা নিতে পারে তার মধ্যে রয়েছে–

১. নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে আমরা চরম ব্যর্থ হয়েছি। যে নিকৃষ্ট উদাহরণ আমরা তৈরি করেছি তার কোনও ক্ষমা বোধহয় হয় না। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। ভবিষ্যতে যেকোনও অস্থিরতার সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে।

২. নীতি এবং আইন প্রণয়ন: শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং শারীরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ আইন ও নীতি প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতেই হবে। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ প্রণোদনা এবং সহায়তার ব্যবস্থা করা এবং সেটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করা জরুরি।

৩. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান: রাষ্ট্রের উচিত শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া এবং মানসিকসেবা প্রদানের জন্য জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত কাউন্সিলর নিয়োগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত।

৪. শিক্ষার সুযোগ অব্যাহত রাখা:  যেকোনও পরিস্থিতিতে সময়ে শিক্ষা যেন ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অনলাইন শিক্ষা, টেলিভিশন বা রেডিওর মাধ্যমে পাঠদান চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

৫. দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল সহায়তাকেন্দ্র স্থাপন: শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের উচিত জরুরি মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তাকেন্দ্র স্থাপন করা। এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীরা সবসময় প্রস্তুত থাকবে, যা শিক্ষার্থীদের দ্রুত মানসিক সহায়তা দেবে।

৬. স্কুলের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন বা নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সংযোগ: স্কুলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের উচিত স্থানীয় প্রশাসন বা নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্কুলগুলোর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে, সদস্যরা নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন করবেন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করবেন।

৭. শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি ও সহায়তা প্যাকেজ: রাষ্ট্রের উচিত সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি এবং আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ চালু করা। এর ফলে, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত হবে এবং তাদের ভবিষ্যতের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।

৮. মানবিক শিক্ষা কর্মসূচি: শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা ও নৈতিকতা গড়ে তুলতে, রাষ্ট্রের উচিত মানবিক শিক্ষা কর্মসূচি চালু করা। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে, শিক্ষার্থীরা কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হবে। তবে শিক্ষক কর্মচারীসহ রাষ্ট্রের সবাইকেই বোধহয় মানবিকতার পাঠের আওতায় আনা জরুরি।

শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি আমাদের সমাজের কিছু ভূমিকা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই নিচের বিষয়গুলো আমরা বিবেচনায় নিতে পারি।

১. স্থানীয় পর্যায়ে মানসিক সহায়তা গ্রুপ তৈরি: সমাজের স্থানীয় স্তরে অভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে মানসিক সহায়তা গ্রুপ তৈরি করা যেতে পারে। এই গ্রুপগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করবে এবং তাদের কষ্টগুলো শোনার এবং সমাধানের চেষ্টা করবে।

২. পাঠাগার এবং ক্লাবের মাধ্যমে পুনর্বাসন কার্যক্রম: সমাজের পাঠাগার, ক্লাব এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা শিক্ষার্থীদের জন্য সাহিত্য, নাটক, সংগীত এবং অন্যান্য সৃজনশীল কার্যক্রমের আয়োজন করতে পারে, যা তাদের মনোভাব পরিবর্তন এবং মানসিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

৩. টেকসই প্রতিবেশী উদ্যোগ: সমাজের প্রত্যেক সদস্যের উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং সমর্থনমূলক প্রতিবেশ তৈরি করা। ‘প্রতিবেশী অভিভাবক’ উদ্যোগের মাধ্যমে, সমাজের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মঙ্গল নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

৪. মানসিক সুস্থতার জন্য উদ্ভাবনী কার্যক্রম: স্থানীয় যুব সংগঠন এবং স্কুলের সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন উদ্ভাবনী কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে, যেমন মনোবিদদের সঙ্গে সেশন, গ্রুপ কাউন্সেলিং এবং মুক্ত আলোচনা। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবে।

৫. স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রম: সমাজের সব ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকেও ট্রমা নিরসন কার্যক্রমে প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রম পরিচালনায় সংযুক্ত করতে হবে।

৬. সুবিধা বঞ্চিত অংশের প্রতি মনোযোগ:  সুবিধা বঞ্চিত যেকোনও জনগোষ্ঠীর শিশু ও শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ ও বিশেষায়িত কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে।

৭. মানবাধিকার ও মনোবিজ্ঞান শিক্ষা:  সংশ্লিষ্ট ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে শিশু অধিকার, মানবাধিকার, মনোবিজ্ঞানে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কাজটি জটিল কিন্তু নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বহুমুখী মিডিয়াকে পরিকল্পিতভাবে এই শিক্ষিত করে তোলার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। সচেতনতামূলক প্রচারণা, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উদ্যোগ, নাটক ও  চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সর্বত্র এই শিক্ষাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।

৮. গণমাধ্যমের ভূমিকা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যম অভিভাবক, পরিবার তথা সমাজের সব স্তরের মানুষকে তাদের নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্রমাগত সাহস জোগাবেন, প্রেরণা দেবেন, অধিকার নিয়ে সচেতন করতে পদক্ষেপ নেবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সহায়ক এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা। সেখানে যাতে শিক্ষার্থীদের লাশের স্তূপ তৈরি করে অবলীলায় ‘মানুষ’ হিসাবে  ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ না থাকে। বরং এমন এক সমাজ তৈরি করতে হবে যেখানে প্রতিটি প্রাণ হবে অমূল্য। প্রতিটি জীবনকে মূল্যায়ন করা হবে। একটি প্রাণের ক্ষতি হলেও যেন আমরা লজ্জিত হই। সমাজের অভিভাবকরা যেন এমন দীক্ষা পান যাতে এমন লজ্জাজনক ভুলে তারা নিজেদের ধিক্কার দেবেন। আমরা আর পেছনে যেতে চাই না। সুন্দরের দিকে এগিয়ে চলার পথে চলুন পরিকল্পিত প্রয়াস নিই।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইগনাইট পাবলিকেশন্স।




👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles