‘কোনও হুমকিতে নেই সেন্টমার্টিন’– এই কথা কতটা সত্য? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পক্ষের প্রচার-প্রচারণা দেখলেই মনে হয়, যে কোনও সময়েই সেন্টমার্টিন ‘দখল’ হয়ে যাবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘাতের মধ্যে সেন্টমার্টিন হাতছাড়া হওয়ার আলোচনা নতুন গতি পেয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমে না আসলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পক্ষ সেন্টমার্টিন মিয়ানমার কর্তৃক দখলের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। ওই প্রচারকারীরা কোনও গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে অমন কথা বলছে তার কোনও উৎস অনেক খুঁজেও পায়নি। অবশ্যই আলোচিত কয়েকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তারা অমন প্রচারণায় যুক্ত হয়ে থাকলে তা ভিন্ন কথা।
যদিও ১৬ জুন গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। তারা জানায়, “মিয়ানমারের চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ সেন্টমার্টিনের নিকটবর্তী হওয়ায় উক্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেন্টমার্টিনের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্নেষী মহল কর্তৃক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সকলকে এধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো”।
যাইহোক, সেন্টমার্টিনকে নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করে সেন্টমার্টিনকে নিজেদের মানচিত্রে যুক্ত করে মিয়ানমার কয়েকবার তাদের মানচিত্র প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই প্রচার-প্রচারণা সামনে এসেছে যে, সেন্টমার্টিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নৌঘাঁটি করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ওই নৌঘাঁটি করতে দিতে রাজি হচ্ছে না বলে তাদের সরাতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তৎপর হয়েছে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিষ্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বাংলাদেশে এয়ার বেজ বানানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে কোন দেশ এই প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি উল্লেখ করেননি প্রধানমন্ত্রী। চলতি বছরের ২৩ মে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের এক বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি এর জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী তার কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে সরাসরি কোনও দেশের নাম বলেননি। সম্প্রতি গণমাধ্যমের এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে।
বাংলাদেশের বিরোধী দলের অনেক নেতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই বক্তব্য আরও পরিষ্কার করে বলতে বলেছেন। কারা চায় তাদের নাম প্রকাশ করতে বলেছেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ওই বিষয়টি নিয়ে আর কথা বাড়ানো হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ারও কোনও জবাব সরকারের তরফ থেকে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী নাকি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি সত্য তার বিচার বিশ্লেষণ করে, অনুসন্ধানী কোনও সংবাদ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়নি।
তবে একথা মনে রাখা দরকার, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান হওয়ায় তার নিকট নানা গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। তিনি যা জানেন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। আর যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যকোনও দেশ যদি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কোনও অংশ নিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে তৎপরতায় চালায় তবে তা কখনও তারা প্রকাশ করবে না। তারা প্রকাশ্য স্বীকার করবে না। সাধারণ ওই ধরনের তৎপরতা অতি গোপনে চালানো হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে। অতি সংগোপনে। সরাসরি সামরিক শক্তি নয়, এক্ষেত্রে সফট পাওয়ার ব্যবহার করা হয়। রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র তৈরির ফর্মুলাই আলাদা।
ভূ-রাজনীতির খেলায় বাংলাদেশ অমন কোনও চক্রে পড়েছে কিনা তা অবশ্যই আমলে নেওয়া দরকার। ওই এলাকায় বাংলাদেশের বাড়তি নজর দেবার এখনই সময়।
ভূ-রাজনীতির খেলায় সেন্টমার্টিন ও তার সংলগ্ন এলাকা বিশ্বপরাশক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান শীতল যুদ্ধে সেন্টমার্টিন কেন্দ্রিক জলরাশির নিয়ন্ত্রণ কার নিকট থাকবে তা শেষপর্যন্ত জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। সেন্টমার্টিনে নৌঘাঁটি নির্মাণ করা যাবে কী যাবে না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ সেন্টমার্টিন এখনও জীবন্ত প্রবাল দ্বীপ। তাছাড়া এর ভূমি ও জলের স্তরে নৌঘাঁটি করলে দ্বীপের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে কিনা সেই প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু নৌঘাঁটি না করেও সেন্টমার্টিন ও তার জলরাশিতে সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। নৌঘাঁটি ছাড়াই বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড ওই এলাকায় তাদের উপস্থিতি বাজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অনুমতি পেলে স্থায়ী নৌঘাঁটি না করেও তাদের সামরিক তৎপরতা চালাতে পারবে। তাই নৌঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সেন্টমার্টিন ও তার জলরাশিতে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় কিনা সেই বিষয়টি।
যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কখনও ওই বিষয়টি না বললেও একথা সত্য যে তাদের চলমান চীন মোকাবিলার নীতির জন্য বঙ্গোপসাগরের জলরাশিতে তাদের নিয়মিত সামরিক উপস্থিতি দরকার। তাদের সাম্প্রতিক দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ নীতিতে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ণের ক্ষেত্রে তারা অতীতের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে তাদের অস্ত্রশস্ত্র যুক্ত করতে এবং সামরিক সদস্যদের অধিক সংখ্যক প্রশিক্ষণ প্রদানে তারা বেশ আগ্রহী।
এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে যেকোনও উপায়েই সম্পর্ক বলবৎ রাখতে চায় তা তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতায় প্রমাণ করে। বিরোধীদলের বর্জন সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেনি। বাংলাদেশে নিযুক্ত বর্তমান রাষ্ট্রদূত ও তাদের নির্বাচন পূর্ব তৎপরতার জন্য যতটা মুখরক্ষা করা দরকার ততটা করেছে। নির্বাচনোত্তর সরকারের সঙ্গে নরম সুরে তাদের কথা বলা এবং চলমান সহযোগিতামূলক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ঘোষণা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সম্প্রতি সাবেক একজন সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাদের ওই সব নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অর্থ তারা বাংলাদেশকে ইরান অথবা উত্তর কোরিয়ার মতো শত্রু রাষ্ট্র বিবেচনা করে বিষয়টি এমন নয়। বরং তারা বাংলাদেশকে আরও কাছে পেতে চায়। বাংলাদেশকে তারা বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে, বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছে বলেই তারা কূটনীতির অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে তারা তাদের বিখ্যাত ‘ক্যারোট ও স্টিক নীতি’ ব্যবহার করছে। এই নীতির ফলে তারা বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই ‘ক্যারোট ও স্টিক নীতি’ প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির কোনও নজির নেই। আশার কথা সেখানে।
তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক মানচিত্র আজকের মতোই আগামী দিনে থাকবে কিনা তা এখনই বলা কঠিন। রাজনৈতিক মানচিত্র স্থির কোনও বিষয় নয়। বাংলাদেশের সীমানা না কমে উল্টো বাড়তেও তো পারে! সীমানা কমবে নাকি বাড়বে তা বলার সময় এখন নয়। ইউক্রেন-ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশের মানচিত্রে ইতোমধ্যে পরিবর্তন হয়েছে বলেই কালই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। তবে অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তন হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত আরাকান আর্মি জয়লাভ করলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি অংশে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তনের এই সম্ভবনা তো রয়েছেই।
কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির ওই লড়াইয়ে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন তারা দখল করবে বলে যে প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চালানো হচ্ছে তার বাস্তবিক কোনও ভিত্তি নেই। কারণ সামরিক ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এই বিষয়টি উপলব্ধি করা যায় যে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অথবা আরাকান আর্মি তাদের চলমান যুদ্ধে এতটা ব্যস্ত যে তারা নতুন কোনও যুদ্ধফ্রন্ট খুলবে না। ন্যূনতম সামরিক জ্ঞান আছে এমন কোনও পক্ষই বাংলাদেশের সঙ্গে বিনা কারণে যুদ্ধে জড়িয়ে শক্তি ক্ষয় করতে চাইবে না। সেন্টামার্টিনের কাছে মিয়ানমারের জলসীমানায় যে যুদ্ধজাহাজের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে অযথা আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ সেন্টমার্টিন ও তার সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতির কারণ বাংলাদেশ নয় বরং আরাকান আর্মিকে মোকাবিলায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ওই যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করেছে। তাই বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ দখলের জন্য ওই যুদ্ধ জাহাজ মোকাবিলা করা হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা প্রচারণা চলাচ্ছেন তারা অযথাই আতংক ছড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলির ঘটনাগুলো মিস ফায়ার হিসেবে বিবেচনা করা ভালো। তবে আরাকান আর্মি ইচ্ছে করেই কিছু ফায়ার করছে। ওই ফায়ার করার কারণ বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ দখল নয় বরং বাংলাদেশের গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও জনপরিসরের দৃষ্টি আর্কষণ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। ওই দুই-একটি গুলি চালানোর মাধ্যমে তারা সেন্টমার্টিন দ্বীপ দখল করে নেবে এমন চিন্তা অলীক কল্পনা।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাষ্ট্রের সীমানা রাত-বিরাত পরিবর্তন হলেও আধুনিক যুগে অমন ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে। তাই মিয়ানমার সেন্টমার্টিনকে দখল করে নেবে এমন প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে জনপরিসরকে বিভ্রান্ত করা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলের বিরত থাকা উচিত। মিয়ানমার ও আরাকান আর্মি প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনী যে নীতি নিয়েছে তা যথার্থ।
কয়েকটি ক্ষেত্রে অস্ত্র-শস্ত্রে বাংলাদেশ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী থেকে পিছিয়ে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। আর সেন্টমার্টিনের মতো একটি দ্বীপকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের নিকট থেকে রক্ষা করার মতো সামরিক শক্তিতো অবশ্যই আছে। সুতরাং এখনই সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তার ন্যূনতম কোনও সম্ভবনা নেই। মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েনের বিপরীতে পাল্টা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে বাংলাদেশকে সংঘাতে জড়ানোর জন্য যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানি দিচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনী ওই উসকানিতে প্রভাবিত হবে না বলে আমরা আশা করি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com