‘বয়কট’ শব্দের সাথে পরিচিত নয় এমন লোক আজকাল পাওয়া দুষ্কর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই শব্দটি এখন সবার কাছে বেশ পরিচিত। ফেসবুকে আজ চলছে তরমুজ বয়কট কিংবা কাল চলছে অন্য কিছুর বয়কট। দিন কয়েক পেরোতে না পেরোতেই একেক সময় একেক বিশেষ গোষ্ঠীরা বিভিন্ন বিষয় বয়কটের ডাক তোলেন।
বয়কট শব্দটি কোথা থেকে এলো কিংবা কিভাবেই চালু হলো বয়কটের যাত্রা এ বিষয়ে জানেন না অনেকেই। এই বয়কট শব্দটির আবির্ভাব হয়েছিল বয়কট নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমেই।
বয়কট লোকটির সম্পূর্ণ নাম চার্লস কানিংহাম বয়কট। ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডের নরফোকে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। লন্ডনের ব্ল্যাকহিথে এক বিদ্যাপীঠে শিক্ষা অর্জন করেছেন বয়কট। শুরুর দিকে নাম ছিল বয়কাট কিন্তু বাবা মা শিশু বয়সেই তার নাম ঠিক করে দেন বয়কট।
বেশ ধনী পরিবারে জন্ম হওয়ায় বয়কটের শৈশব-কৈশোর সুখেই কেটেছে। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবেন। এজন্য ১৯৪৮ সালে রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও চূড়ান্ত পরীক্ষায় বাদ পড়ে যান তিনি। কিন্তু বাবার সম্পদ ও অর্থ থাকায় ৪৫০ পাউন্ড দিয়ে ১৮৪৯ সালে যোগ দেন আর্মির ক্যাপ্টেন পদে। এরপর পদোন্নতি পেয়ে যোগ দেন ৩৯তম ফুট রেজিমেন্টে। এরপর চাকরির সুবাদে বদলি হয়ে আসেন আয়ারল্যান্ডে। ১৮৫১ সালে অসুস্থ হওয়ার পর ছেড়ে দেন সেনাবাহিনীর চাকরি। আয়ারল্যান্ডে স্থায়ী হয়ে বিয়ে করেন মেরি আন দুনেকে।
বয়কট এরপর শুরু করেন জমির দেখভালের ব্যবসা। মায়ো কাউন্টির পাশে আচিল দ্বীপে অল্প জমিও কিনেন। চাষবাসের পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডের আর্ল অফ আর্নের জমি বিক্রি ও দেখভালের প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।
আর্নের মালিকানাধীন ৪০ হাজার একর জমি দেখভাল করে বেশ ভালোই সময় কাটছিল বয়কটের। সেসব জমি চাষ করা কৃষকদের থেকে খাজনা আদায়, জমির হিসেব বুঝিয়ে নেওয়াসহ তাদের ওপর অত্যাচার ও জমি থেকে উচ্ছেদ করাই ছিল তার কাজ।
ভারতীয় জমিদার ও ভূস্বামীরা যেভাবে বর্গাচাষীদের ওপর অত্যাচার করত, একই ধরনের কাজ করতেন বয়কট। তিনি ভাবতেন, জমি ও কৃষকের প্রভু জমির মালিক। কেউ কথা না শুনলে তাদের ওপর চালাতেন নির্যাতন। বর্গাচাষীদের নির্যাতনের পাশাপাশি কেড়ে নিতেন তাদের অল্প সম্পত্তিও।
বয়কটের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নির্যাতিত কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। ১৮৭৯ সালে মাইকেল ডেভিড নামে এক কৃষকের নেতৃত্বে মায়ো প্রদেশে যাত্রা শুরু করে আইরিশ ন্যাশনাল ল্যান্ড লিগ। খাজনার অত্যাচার ও উচ্ছেদ থেকে বাঁচতে এক হতে থাকেন কৃষকরা। মালিক যে জমি তার নয় বরং লাঙল যার জমি তার দাবি আদায়ে সোচ্চার হন কৃষকরা।
১৮৮০ সালে কৃষকরা দাবি জানান, খাজনা কমাতে। কৃষকরা ২৫ শতাংশ কমাতে বললেও সেসময় খাজনা কমে মাত্র ১০ শতাংশ। সেই খাজনা অনেকে কৃষক দিতে না পারলে তাদের ওপরেও নির্যাতন চালাতেন বয়কট। উচ্ছেদকৃত কৃষকরা একসময় বিচার জানান কেন্দ্রীয় সংসদে।
সংসদ সদস্য চার্লস স্টুয়ার্ট পার্নেল সেসময় কৃষকদের পক্ষ নিয়ে বলেন, অত্যাচারী কাউকে সমীহ করা যাবে না, অত্যাচারীকে উপেক্ষা করতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। এরপর যেন বয়কটের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
কেউ বয়কটের জমি চাষ করেন না, ক্ষেতে সেচ দেন না। এভাবে সব ক্ষেত শুকিয়ে যেতে লাগলো। সব ফসল নষ্ট হলো। কেউ বয়কটের সঙ্গে কথা বলেন না, এমনকি ডাকপিয়নও বয়কটের ডাকে সারা দেন না।
নিজের এমন দুঃসময়ে পত্রিকায় খোলা চিঠি লিখে সাহায্য চান বয়কট। সেই চিঠি দেখে সাড়া দেন তার বন্ধুরা। ডাবলিন ও বেলফাস্টে থাকা তার বন্ধুরা ফসল কাটতে ৫০ জন লোক পাঠান মায়োতে। সেই ৫০ শ্রমিকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করা হয় ৯০০ সশস্ত্র সেনাসদস্য। এতে ফসল কেটে ঘরে তোলা গেলেও বেশ লোকসান হয় বয়কটের।
এসব ঘটনার পরে আশেপাশের দেশেও ছড়িয়ে পড়ে বয়কটের নাম। পত্রিকায় নানা খবর ও ছবি ছাপা হয় বয়কটের নামে। এরপর ইংল্যান্ডের কোথাও বা আশেপাশের দেশে জমিদার ও ভূস্বামীরা কৃষকদের অত্যাচার করলেই নেওয়া হতো এমন ব্যবস্থা।
একপর্যায়ে বয়কট পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে পরিচয় দিতেন, কানিংহাম নামে। একসময় পাড়ি জমান আমেরিকায়। অনেকটা আড়ালে থেকেই ১৮৯৭ সালে মারা যান বয়কট।
বয়কট শব্দটি দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছিলেন বয়কট নিজেই। ১৮৮৮ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে জায়গা করে নেয় ‘বয়কট’ শব্দটি।