‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি’, ‘আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালুহু, শেষ করা তো যায় না গেয়ে তোমার গুণগান’—খালি গলায় উচ্চস্বরে বাজনা বাজিয়ে এমন অসংখ্য ইসলামি সংগীত গেয়ে ৪০ বছর ধরে প্রতি রমজানে সেহরির সময় ডেকে ডেকে রোজাদারদের ঘুম ভাঙান পুরান ঢাকার কলতাবাজারের বাসিন্দা মো. ভুট্টু মিয়া। ষাটোর্ধ্ব ভুট্টু মিয়া স্থানীয়দের কাছে ভুট্টো চাচা বলেই সমাদৃত।
তার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সেহরি খান পুরান ঢাকার রোজাদাররা। সেহরির সময় বিভিন্ন ধরনের সংগীত বা গজল গেয়ে বাদ্য বাজিয়ে মানুষের ঘুম ভাঙানোর এই রীতি কাসিদা নামে পরিচিত। চার দশকের ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছেন ভুট্টো মিয়া। স্থানীয়রা জানান, ঐতিহ্যবাহী এই কাসিদা সংস্কৃতি বিলীন হওয়ার পথে। ভুট্টো মিয়ার পরে এই সংস্কৃতি কীভাবে টিকে থাকবে সে নিয়ে চিন্তিত তারা।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতি সম্পর্কে কলতাবাজারের বাসিন্দা রবিউল রবিন বলেন—ভুট্টু চাচা সুরে সুরে খুব যত্ন নিয়ে আমাদের মহল্লার অলিগলি ঘুরে সবাইকে সেহরি খাওয়ার জন্য জাগানোর চেষ্টা করেন। একটা সময় ছিল, তখন গলায় পেঁচানো গামছায় ঝুলন্ত হারমোনিয়াম, কারও হাতে হ্যাজাক বাতি, কারও হাতে ডুগডুগি, কারও হাতে থাকতো করতাল। সুললিত কণ্ঠে ছন্দময় গলায় বিশেষ এক সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে মহল্লাবাসীকে ঘুম থেকে তুলে সেহরি খাওয়ার আহ্বান জানাতেন তারা। এখন আর সেই দিন নেই। এখন শুধু ভুট্টু চাচা একাই মানুষকে সেহরি খাওয়ার জন্য ডাকেন।
তিনি আরও বলেন, একসময় কাসিদাকে ঘিরে পুরান ঢাকায় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য গায়েন দল। কিন্তু কালের বিবর্তনে কাসিদা আজ বিলুপ্ত। পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আজ আর ভেসে আসে না সুরেলা কণ্ঠে সেহরি খাওয়ার আহ্বান। এখন মসজিদের মাইকে, মোবাইল ফোনের অ্যালার্মেই ঘুম ভাঙে। তবে এখনও আমাদের পাড়া-মহল্লায় আছেন সবার প্রিয় ভুট্টু চাচা। বলা চলে পুরান ঢাকায় তিনি এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
বাংলা ট্রিবিউনকে ভুট্টু মিয়া বলেন, ৪০ বছর ধরে আমি প্রতি রমজানে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের গজল গেয়ে ও বাদ্য বাজিয়ে সেহরির সময় ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করে আসছি। একটা সময় ছিল আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন দলবেঁধে সুরে সুরে গজল গাইতো, তবলা বাজাতো, হারমোনিয়াম বাজাতো, উর্দু গান গাইতো। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই, সেই লোকগুলোও নেই। তারা সবাই এখন পরপারে চলে গেছেন। আমি এখনও একাই এই কাজ করি। এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এটা করতে বেশ ভালোই লাগে।
তিনি আরও বলেন, ঝড়-বৃষ্টি হোক, যাই হোক না কেন বা আমার অসুস্থতা থাকুক, এটা মুখ্য বিষয় না। আমার কাছে সবসময় এই কাজটা প্রাধান্য পেয়েছে। আমি চলে গেলে এই কাজ হয়তো আর কেউ করবে না। এখন তো যুগের পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো পুরান ঢাকার এই রীতিনীতিটাও হারিয়ে যাবে। গত ৫০ বছর ধরে কত পরিবর্তন দেখলাম। আমি চাই আমার পরে এই সংস্কৃতির কেউ হাল ধরুক।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘুম ভাঙানিয়া কাসিদা সংস্কৃতি
দুই যুগ আগেও রাজধানীজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রচলন ছিল কাসিদা সংস্কৃতির। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতি। তবে রাজধানীর কিছু জায়গায় এখনও রমজান মাসজুড়ে শেষ রাতে দেখা মিলে ঘুম ভাঙানো কাসিদার। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অলিগলিতে বয়োবৃদ্ধদের মাঝে বেঁচে আছে এই সংস্কৃতি।
পুরান ঢাকার বয়স্কদের কাছ থেকে জানা যায়, একসময় বুড়িগঙ্গার পানির ওপর দিয়ে অন্ধকারে ভেসে আসতো উর্দু সংগীত। মাইকে সেহরির আহ্বান। আর সংগীতের মৃদু বাজনা মিশে যেতো নৌকা চলার শব্দের সঙ্গে। এই দৃশ্যের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম অনেকটা অপরিচিত। তবে আগের প্রজন্মের কাছে বিষয়টি জানা। বিশেষত যারা পুরান ঢাকার বাসিন্দা, রমজানে শেষ রাতের দিকে এই আহ্বান শোনার জন্য তাদের মন অপেক্ষায় থাকে এখনও।
রমজান এলেই পুরান ঢাকায় সেহরির সময় রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর জন্য মহল্লায় মহল্লায় কাসিদা গাওয়া হতো। এটিকে তারা সওয়াবের কাজ মনে করতেন। আর ঈদের দিন মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরানা নিয়ে আসতেন। দুই দশক আগেও ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, মোহাম্মদপুর এলাকায় কাসিদার প্রচলন ছিল। এমনকি এক যুগ আগেও পুরান ঢাকার পাতলা খান লেন, লক্ষ্মীবাজার এলাকায় কাসিদার বেশ প্রচলন ছিল।
কাসিদা’র সমৃদ্ধ ইতিহাস
ঢাকায় যে গজল বা কাসিদা গাওয়ার রীতি দেখা যায়, এটি শুধু বাংলা,আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি ভাষার মিশ্রণে গজল গাওয়া নয়। এর উৎস জানতে হলে খুলতে হবে ইতিহাসের পাতা। কাসিদার জন্ম দশম শতাব্দীতে পারস্য তথা ইরানের কবিদের হাতে। তখন কবিরা ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে কাসিদা লিখতেন। ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ মহাকাব্যের চেয়ে একটু ভিন্ন ঢঙে প্রথম কাসিদা লেখেন কবি রুদাকি। তখন কাসিদা লেখা হতো প্রশস্তিগাঁথা, শোকগাথা, নীতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক।
গজনীর সুলতান মাহমুদের দরবারে ছিলেন ৪০০ জন কবি। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ফারোখি। কবি আনভারিকেও শীর্ষস্থান দেওয়া হয়। কবি নাসির খসরুর কাসিদায় দর্শনতত্ত্ব, আল্লাহতত্ত্ব এবং নৈতিকতা মিলেমিশে একাকার ছিল বলে বিশেষ খ্যাতিও লাভ করেন তিনি। আভিসেন্না কাসিদা লিখতেন কেবল দর্শনতত্ত্ব নির্ভর। লিখতেন কবি আসজাদিও।
ধারণা করা হয়, কাসিদার প্রথম ধরনটা হচ্ছে ‘বসন্তের কবিতা’। ফারসিতে যাকে বলে ‘বাহারিয়াহ’। অন্য ধরনটি হচ্ছে ‘খাজানিয়াহ’ বা শরতের কবিতা। কাসিদা লেখা প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েই শুরু হতো। তার সঙ্গে মৌসুম, প্রাকৃতিক দৃশ্য বা মজার দৃশ্যকল্প জুড়ে দেওয়া হতো। আর ‘তাখাল্লাস’ বা স্মৃতিকাতর অংশে কবি নিজের লেখক নাম ধরেই লেখা শুরু করতেন। শেষ অংশে থাকতো কেন কবিতাটা লেখা হয়েছে সেই উদ্দেশ্য।
১৪ শতকের দিকে কাসিদা থেকে গজল রচনার হিড়িক পড়ে যায়। কেননা, ততদিনে ফারসিতে কাসিদার কদর কমতে থাকে। ফলে বন্দনামূলক উর্দু গজলের চর্চা শুরু হয়। কাসিদার প্রথম অংশকে ঘষামাজা করেই দৃশ্যকল্প ও মিষ্টি ভাষা দিয়ে এসব গজল সহজেই লেখা হতো। গজল কাসিদার চেয়ে ছোট ও সহজে বোধগম্য হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মানুষের মধ্যে।
মুঘলদের দাফতরিক ভাষা ফারসি হওয়ায় বাংলায় ফারসি ভাষায় কাসিদার আগমন হয়। পূর্ববঙ্গে মুঘল সেনাপতি মির্জা নাথানের ‘বাহারিসত্মান-ই-গায়বি’তে কাসিদার প্রাচীন তথ্য পাওয়া যায়। ইসলাম খান চিশতির সঙ্গে ১৬০৮ সালে মুঘল নৌবহরের সেনাপতি হিসেবে বঙ্গে এসেছিলেন মির্জা নাথান। তিনি সামরিক অভিযানে যান যশোরে। সেখানে আস্তানায় এক বিশাল আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে কবিরা নিজেদের লেখা কবিতা বা কাসিদা পরিবেশন করেন। সবার অনুরোধে যশোরের আবহাওয়া নিয়ে স্বরচিত কাসিদা আবৃত্তি করেন কবি আগাহি।
ঢাকায় কবে থেকে কাসিদা’র যাত্রা
ঢাকায় রমজানে কবে, কখন থেকে কাসিদার প্রচলন শুরু হয়, তা নিয়ে মতভেদ আছে। ধারণা করা হয়, মুঘল আমলে শুরু হলেও ইংরেজ আমলে এসে তার শানশওকতে মরিচা পড়ে। এশিয়াটিক সোসাইটির ঢাকা কোষ বইয়ে নবাবি আমলে মহল্লার সর্দারদের কাসিদার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার কথা পাওয়া যায়। তবে লেখক, সাংবাদিক হাকিম হাবিবুর রহমানের বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হয়তো আবার তার প্রচলন ঘটে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭-এর পর উর্দুভাষী মোহাজেররা ঢাকায় এসে কাসিদায় নতুন মাত্রা যোগ করেন।
ঢাকায় শুধু রমজানেই নয়, ঈদুল ফিতর ও মহররম উপলক্ষেও কাসিদা রচনা করা হতো। ১৯৯২ সালে ‘হোসনি দালান পঞ্চায়েত’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন কাসিদা দল নিয়ে গড়ে তোলা হয় প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের আয়োজন। এখনও সে প্রতিযোগিতা উর্দু রোডে ২০ রমজান রাত ১১টা থেকে শুরু হয়ে চলে সাহরির সময় পর্যন্ত। এছাড়া হোসনি দালান, কসাইটুলি, খাজে দেওয়ান, বকশিবাজার, মিটফোর্ডসহ কয়েকটি মহল্লায় চলে কাসিদা প্রতিযোগিতা।
কাসিদার সুর প্রয়োগ করা হয় শাহেদি, মার্সিয়া, নাত-এ রাসুল, ভৈরবি, মালকোষ প্রভৃতি রাগে। অধিকাংশ কাসিদার সুর তৎকালীন ছায়াছবির গান থেকে নেওয়া। কাসিদা মূলত গাওয়া হয় সম্মেলিত কণ্ঠে। এই সংগীত যারা লিখতেন, তাদের বলা হয় কাসেদ। যিনি দলের নেতৃত্ব দেন, তাকে বলা হয় সালারে কাফেলা। তিন রকমের কাসিদার কথা বিভিন্ন বইপত্রে উল্লেখ আছে। এগুলো হলো আমাদি, ফাজায়েলি, রুখসাতি বা বিদায়ী।
POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…
- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…
Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…
Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…
Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…
Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…