Categories: Bangladesh News

শরীফার গল্প বাদ দিতে কমিটির সুপারিশ ছিল ‘একপেশে’


মাধ্যমিক পর্যায়ের এক পাঠ্যপুস্তকে ‘শরীফার গল্প’ নামে একটি পাঠের ‘প্রতিটি লাইন ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কিত, যা বিশ্বব্যাপী আপত্তিজনক’— এমন মন্তব্য করে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা কমিটি। শুধু তাই নয়, পাঠটিকে ‘বিভ্রান্তিকর, ইসলাম এবং সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী’ গল্প বলেই অভিহিত করা হয়েছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন— ট্রান্সজেন্ডার এখন আর বিশ্বব্যাপী আপত্তির বিষয় নয়। বরং বিশ্বের অনেক দেশে লিঙ্গ বৈচিত্র্য মানুষ বা ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে শিশু ও শিক্ষার্থীদের পাঠ্য। তাদের প্রতি মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছে। আমাদেরও সেদিকেই যেতে হবে। মানুষ হিসেবে কাউকে অসম্মান করার শিক্ষা কোনও ধর্মে নেই, থাকতে পারে না।

নতুন কারিকুলামে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ তুলে ধরতে ‘শরীফার গল্প’ উপস্থান করা হয়েছিল সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে। এই গল্পটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে। বিরূপ সমালোচনার পর ‘শরীফার গল্প’ পর্যালোচনায় উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটি পাঠ্যবই থেকে গল্পটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুর রশীদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ।

কমিটির সুপারিশে শরীফার গল্প বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে এ ধরনের কোনও গল্প সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত নয় বলে মন্তব্য করা হয়। তবে পাঠ্যবইয়ে হিজড়াদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরার সুপারিশ করা হয়।

গত জুন মাসে জমা দেওয়া কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে পর্যালোচনা কমিটির সদস্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) ও এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে— শিখন অর্জন। শিখন অর্জনে কোনও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি প্রতিবন্ধকতাও তৈরি হচ্ছে না। যেহেতু এটা নিয়ে বিতর্ক আছে, আপত্তি আছে; সুতরাং শরীফার গল্পটি পরিবর্তন করে অন্য গল্পের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা যাবে।’

কমিটির সুপারিশ

কমিটির সুপারিশে বলা হয়, ‘শরীফার গল্পের’ প্রতিটি লাইন ও শব্দ পর্যালোচনায় দৃঢ়ভাবে বলা যায়, গল্পটি সন্দেহাতীতভাবে ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কিত, যা বিশ্বব্যাপী আপত্তিজনক একটি মতবাদ। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বয়স ১২-১৩ বছর। কোনোক্রমেই তাদের জন্য ‘শরীফার গল্প’ বা এ ধরনের কোনও গল্প উপযুক্ত নয়। এরূপ বিভ্রান্তিকর, ইসলাম এবং সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী গল্প বা বক্তব্য শিক্ষা ব্যবস্থার কোনও পর্যায়ে সংযোজন করা উচিত নয়। অতএব ‘শরীফার গল্প’টি পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হলো।’

বিশিষ্টজনদের অভিমত

গল্পটিকে শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়নি, দেখা হয়েছে রাজনৈতিক এক দৃষ্টিকোণ থেকে এমটা মনে করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ধর্মের মানবিক দিকটাও এখানে দেখা হয়নি। আমাদের ধর্মে মানুষকে মূল্য দিতে বলা হয়েছে, আল্লাহর সৃষ্ট প্রত্যেক জীবনকে সম্মান করতে বলা হয়েছে। মহানবী ক্রীতদাসদের মুক্তি দিয়েছেন, দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের জন্য লড়াই করেছেন। ইসলামের জনপ্রিয়তার মূলে ছিল মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। এই ভালোবাসার যে প্রকাশ ইসলাম দেখাতে বলে তা এই সময়ে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’

পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত কোনও শিক্ষণীয় লেখাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখাটা অনুচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীব্যাপী শিক্ষার মানদণ্ড হচ্ছে— মানবিক সমতা ও অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। পূর্ব কিংবা পশ্চিমের স্কুলগুলোতে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি স্বচ্ছ এবং সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি শেখানো হয়, যা আমাদের ধর্ম সমর্থন করে। এই সিদ্ধান্ত (পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া) যদি শিক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নেওয়া হতো, তাহলে তা এই জায়গায় পৌঁছাতো না। আমি বিশ্বাস করি, এই গল্প ক্লাস সেভেনে না দিয়ে ক্লাস এইটে বা নাইনে পড়ানো যেতে পারে। এটি ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। আমাদের দেশের বিবেচনায় সন্তানেরা অল্প বয়সে বাবা-মার সঙ্গে অনেক কিছুই আলাপ করে না, যা পশ্চিমে করে। পশ্চিমে যে বিষয়গুলো শিক্ষাক্রমে আগে চলে আসে, সেগুলো আমাদের দেশে দেরিতে পড়ানো হয়। তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু স্কুল জীবনের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সমাজ সম্পর্কে অনেক কিছুই শেখাতে হবে। তাহলে আমার মনে হয়, তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে।’

এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, ‘শিক্ষার একটি সংস্কৃতি আছে, একটি মূল্যবোধ আছে। সেসব দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা, আমরা যদি বিশ্বাস করি সৃষ্টির প্রতিটি প্রাণী আল্লাহ তৈরি করেছেন, তাহলে তাদেরও (ট্রান্সজেন্ডার) সেই দৃষ্টিতে দেখা উচিত। তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি সহানুভূতিশীল না হয়, মানবিক না হয় তাহলে তো আমরা সত্যিকার অর্থে ধর্মের পাঠটা গ্রহণ করতে পারবো না। আমাদের শিক্ষাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিতে অনেক কিছুই আমাদের জানতে হবে। তবে গল্পটা পুনর্লিখিত হতে পারে। মূল চিন্তাটি ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হতে পারে। এই শিক্ষার্থীরা যখন বিদেশে পড়তে যাবে, দেখবে অনেক কিছুই তাকে জানতে হচ্ছে। সেজন্য তার জ্ঞানের ভিত্তিটা মজবুত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘টিকটক বা চাইল্ড পর্নোগ্রাফি শিশুদের মনোজগতে যে পচন ধরাচ্ছে, মাদক তাদের যেভাবে ধ্বংস করেছে সেদিকেও তো সবার সজাগ থাকার কথা। যারা পাঠ্যবইয়ের একটি গল্প বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন, আমি আশা করি, চাইল্ড পর্নোগ্রাফি নির্মূলে তারা রাস্তায় নামবেন। আমি তাদের আহ্বান জানাই, সক্রিয়ভাবে টিকটক বা ইউটিউবের বিনষ্টকারী কনটেন্টগুলোর বিরুদ্ধেও তারা যেন সক্রিয় হন। তারা নিশ্চয় নীতিবোধ দ্বারা তাড়িত। তাদের অনুরোধ করবো, তারা যেন অনলাইন-বাহিত, শিশুদের বিভ্রান্ত করা বিষয়গুলির বিরুদ্ধে কাজে নামেন, যাতে সত্যিকার অর্থে শিশুদের আমরা নিরাপদ রাখতে পারি।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, অন্তত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ-স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা ও চিন্তা-ভাবনা প্রবর্তনকারী সরকার ব্যাকওয়ার্ড চিন্তা করবে না। সাহস করে বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে নিয়ে আসবেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, আমরা পিছু হটলাম। এই বয়সী বাচ্চাদের যদি শরীফার গল্প না পড়ানো হয়, তাহলে তার বিকল্প কেন বলেননি তারা? ট্রান্সজেন্ডারসহ লিঙ্গ বৈচিত্র্য বিষয় হোক, সংশোধন-পরিমার্জনের কথা না বলে সরাসরি বলে দিয়েছেন এটা থাকবে না। এটা আরও যুগোপযোগী ও পরিচালিত করা যেতো।’

এই শিক্ষাবিদের মতে, ‘যারা পর্যালোচনা কমিটিতে ছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ সমাজ বিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী ছিলেন না। এটি স্বাস্থ্যের বিষয়, অথচ কোনও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। নারী ইস্যু বা জেন্ডার নিয়ে যারা কাজ করেন, তারাও কেউ ছিলেন না কমিটিতে। বলতে পারি, এটি একপেশে হয়ে গেছে। এতে তো ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণাকেই পিছিয়ে নেওয়া হলো। নতুন একটি অগ্রসরমুখী শিক্ষাক্রম, তাকে মনে হচ্ছে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

শরীফার গল্পের বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘যদি আমরা দেখতাম মাদকের কারণে যে শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দেশে কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে; তাদের বিষয়ে তারা (বিরোধিতাকারী) এ রকম কিছু করছেন! কিন্তু তা তো দেখছি না। অথচ তারা এটার (শরীফার গল্প) পেছনে লেগেছেন।’

শিক্ষা গবেষক কে এম এনামুল হক বলেন, ‘এই সুপারিশের বক্তব্য বাস্তবসম্মত নয়, তাই আমি এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। মানুষ শুধু নারী কিংবা পুরুষ নয়, লিঙ্গ বৈচিত্র্যের আরও মানুষ আছে। সব মানুষই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। তাই প্রত্যেকেরই মানুষ হিসেবে একটি অধিকার আছে। সুপারিশের বক্তব্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে মানুষকে অস্বীকার করে। সিডো সনদে দুটি ক্ষেত্রে রিজারভেশন থাকা স্বত্বেও বাংলাদেশ ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটি স্বীকৃতি দিয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকার সনদে উল্লিখিত শিশু সুরক্ষাসহ অন্যান্য মানবাধিকার এবং ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটি বিদ্যালয় পর্যায়ে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তাই পাঠ্যবইয়ে এর ব্যবহার থাকা প্রয়োজন। এছাড়াও ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ বিশ্বব্যাপী আপত্তিজনক বা সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী নয়। বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সম্পর্কে শিশুদের শেখানো হয়। সিভিল ও পলিটিক্যাল রাইটস বিষয়ক সনদেও ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটির স্বীকৃতি রয়েছে।’

এই গবেষক মনে করেন, ‘ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে শিশুদের জানার প্রয়োজন আছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪.৭- বিশ্বনাগরিকত্ব ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে শিশু ও যুবদের যেসব বিষয় জানতে হবে, তার মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বা লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমি মনে করি, শরীফার গল্প সাময়িকভাবে কিছু মানুষের মাঝে প্রশ্নের উদ্রেক করলেও দীর্ঘমেয়াদে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’

আরও পড়ুন- 

‘শরীফার গল্প’ বাদ, নতুন কী গল্প আসছে

পাঠ্যবইয়ে নতুন গল্পের সুপারিশ, হিজড়াদের ভিন্ন চোখে দেখা যাবে না


👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Uncomm

Share
Published by
Uncomm

Recent Posts

That is the POCO X7 Professional Iron Man Version

POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…

9 months ago

New 50 Sequence Graphics Playing cards

- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…

9 months ago

Good Garments Definition, Working, Expertise & Functions

Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…

9 months ago

SparkFun Spooktacular – Information – SparkFun Electronics

Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…

9 months ago

PWMpot approximates a Dpot

Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…

9 months ago

Keysight Expands Novus Portfolio with Compact Automotive Software program Outlined Automobile Check Answer

Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…

9 months ago