Categories: Bangladesh News

যে পৃথিবীর আকাশে দুটো চাঁদ


যেকোনো কাজ সবচেয়ে সহজ এবং আরামদায়ক উপায়ে সমাধান করতে ওস্তাদ প্রাণী হল মানুষ। ফেসবুক রিলস বা ইউটিউব শর্টসের ১৫ সেকেন্ড মেয়াদি ভিডিওতেই যদি বিনোদনের কাজ হয়ে যায়, সময় ‘ভালো কাটে’, তখন ২০২৪ সালের প্রেক্ষিতে গাঁটের পয়সা খরচ করে কিনে পড়া লাগে, এমন এক ১৩০০ পৃষ্ঠার বেশি ঢাউশ উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা ও ব্যবসায়িক সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু? তবে লেখকের নাম যদি হয় হারুকি মুরাকামি, তবে প্রকাশক— পাঠকরা এখনও স্বাচ্ছন্দ্যে বাজি ধরতে চান ছাপা বইয়ের ওপর। সোশ্যাল মিডিয়ার মতো ব্রেইন থেকে তড়িৎ গতিতে ডোপামিন ক্ষরণ না করতে পারলেও, ধৈর্য ধরে একবার মুরাকামির যেকোনো লেখার মধ্যে ঢুকে গেলে বই শেষ করার আগ পর্যন্ত তার ঘোর সৃষ্টি করা জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো উপায় নেই। তিন খণ্ডে, এবং সর্বমোট ১৩১৮ পৃষ্ঠায় রচিত মুরাকামির উপন্যাস 1Q84 পড়ে শেষ করলাম এইতো সেদিন, পুরো দেশ যখন আন্দোলনে উত্তাল, আর দেশের ইন্টারনেট যখন ‘এমনি এমনি’ বন্ধ হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে মাত্র এক সপ্তাহে উপন্যাসটি পড়া শেষও হয়ে গেলো। আবিষ্কার করলাম, এখনও মুরাকামি পাঠের অভিজ্ঞতা— ব্যাকপ্যাক কাঁধে কোনো গহিন জঙ্গলে ক্যাম্পিং করার জন্য ঢুকে পড়ার মতোই রোমাঞ্চকর।

যেকোনো উপন্যাস পাঠে, আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি— লেখক কী কী প্রশ্ন উত্থাপন করলেন তার পাঠকের সামনে। এ উপন্যাসে মুরাকামি আমাদের জিজ্ঞেস করেন, প্রবল ক্ষমতাধর, এবং সবরকমের মন্দের আকর মনে করা শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তাকে দুর্বল অবস্থায় পেয়ে, প্রতিশোধ নেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে যদি দেখা যায় যে— আসলে সে দোষী নয়, অথবা ভালো মন্দ বিচারের নিক্তিতে তাকে বিচার করা হয়েছে, গলদ রয়েছে তাতেই, তখন একজন ব্যক্তির কী করার থাকে? একই সঙ্গে মুরাকামির এ উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই একাকিত্বে আক্রান্ত। মুরাকামি তার পাঠককে প্রশ্ন করেন— ভালোবাসাই যদি হৃদয়হীন পৃথিবীতে টিকে থাকার মূলমন্ত্র হয়, তবে একজন একাকী মানুষের রেহাই পাওয়ার উপায় কী? ন্যায়—অন্যায়, আর ভালোবাসা বনাম একাকিত্বের দ্বন্দ্বই এ উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে ক্রমশ।

উপন্যাসটি মুখ্যত প্রেমের উপন্যাস। ২০০৯ সালে এই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে মুরাকামি বলেছিলেন— এতে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ প্রেমের গল্পটিকে সবচেয়ে জটিলভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। বলা বাহুল্য, তিনি তাতে সফল। উপন্যাসটির নায়ক ট্যাঙ্গো কাওয়ানা, এবং নায়িকা আওমামের প্রথম পরিচয় শৈশবে, স্কুলে। তারপর তাদের আলাদা হয়ে যাওয়া, এবং পরিণত বয়সে এক ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীতে পুনরায় মিলিত হওয়া এই নিয়েই তো উপন্যাসটি। তার মধ্যেই মসৃণভাবে গল্পের মাঝে ঢুকে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিবিধ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কাল্টের বয়ান, জাদুবাস্তবতা, প্যারালাল ইউনিভার্স, অথোরিটেরিয়ান বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের সামনে মানুষের অসহায়ত্ব, শিশু যৌন নির্যাতন, পরকীয়া, একাকিত্ব, মাজা—দোহতা তথা দেহ ও আত্মার দ্বৈততা সহ আরও কতোকিছু!


নায়ক ট্যাঙ্গো একটি কোচিং সেন্টারে অঙ্কের শিক্ষক এবং তরুণ লেখক। হঠাৎ করেই একটা ফ্রিঞ্জ ধর্মীয় গোষ্ঠীর আধিভৌতিক জনজীবন নিয়ে ১৭ বছর বয়সী তরুণী— ‘ফুকা ইরি’ এর লেখা একটি নভেলা তার হাতে এসে পড়ে, সম্পাদনা করার জন্য। বইটা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল লেখক এবং তার সাথে সম্পাদক ট্যাঙ্গো নিজে বিপদে জড়িয়ে পড়ে—প্রতীকী বইটির উগ্রপন্থি ধর্মীয় গ্রুপ সাকিগেইকের কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। দলটি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে বইটির লেখা ও প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত সকলের প্রতি। অপরদিকে নায়িকা আওমামে, যে দিনে নারীদের আত্মরক্ষা ও শারীরিক শক্তিবৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দেয়, এবং রাতে ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করে, তার কাঁধে এসে পড়ে সেই উগ্রপন্থি ধর্মীয় দল সাকিগেইকের মূল ধর্মগুরুকে হত্যা করার। ধর্মগুরুর অপরাধ, সে ধর্মীয় সংস্কারের নামে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের ধর্ষণ করে। এই দুই ঘটনার স্রোত পরে মিলেমিশে এক বিশাল টর্নেডোর আকার ধারণ করে দুর্দান্ত গতিতে উপন্যাসকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ইন্টারটেক্সুয়ালিটি, তথা পূর্বের ক্লাসিক কাজগুলোকে নিজের কাজের সাথে মিশিয়ে দেয়া মুরাকামির অভ্যাস। এই উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। 1Q84 নামটা শুনলেই আমাদের সবার মনে আসে জর্জ অরওয়েলের 1984 উপন্যাসটির নাম। অরওয়েলের উপন্যাসে যেমন বিগব্রাদার নামে চোখে দেখা যায় না, অথচ বাকি চরিত্র সবাই তাদের নজরদারিতে বন্দী, এমন এক অদৃশ্য আধিভৌতিক শক্তি থাকে, মুরাকামির এই উপন্যাসে বিগব্রাদারের বদলে উপস্থিত লিটল পিপল নামে অদ্ভুত ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন এক গোষ্ঠী। এই লিটল পিপলের কনসেপ্ট অবশ্য মুরাকামির ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ছোটগল্পের বই ‘দা ইলিফেন্ট ভ্যানিশেস’ বইয়ের ‘টিভি পিপল’ নামক গল্পে আগেও ছিল। এছাড়াও মূল পুরুষ চরিত্রের ট্যাঙ্গোর বাসায় এক বিবাহিত মহিলা নিয়মিতভাবে প্রতিসপ্তাহে একদিন এসে ট্যাঙ্গোর সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হয়ে আবার নিজের প্রাত্যহিক জীবনে ফিরে যায়, ঠিক এমন ঘটনা মুরাকামির ‘মেন উইদাউট ওমেন’(২০১৪) গল্পগ্রন্থের ‘শেহেরজাদ’ গল্পে আছে। বড় উপন্যাসে এরকম অনেক রিকারেন্ট থিম ফিরে ফিরে আসে। মুরাকামির অন্য সব লেখার মতো এই উপন্যাসেও যৌনতা এসে হাজির হয় অত্যন্ত মসৃণভাবে, দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে। যৌনতার সহজসরল মুরাকামিয় বর্ণনা এক ভিন্ন ধাঁচের আর্ট।

এ উপন্যাসকে আরও বিশেষায়িত করেছে জাদুবাস্তবতার ব্যবহার। পুরো উপন্যাস জুড়ে মুখ্য ভিলেন লিটল পিপলের রোমহর্ষক উপস্থিতি, সাকিগেইক ধর্মের ধর্মগুরুর মৃত্যুদৃশ্য, ১৭ বছরের কিশোরী ফুকা ইরির সঙ্গে নায়ক ট্যাঙ্গোর সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া, এবং সেই সঙ্গমের সূত্রে নায়িকা আওমামের কোনোরূপ যৌনমিলন ছাড়াই ট্যাঙ্গোর সন্তানকে গর্ভে ধারণ, সমান্তরাল পৃথিবী (Parallel Universe) এর ধারণা, আকাশে দুটো চাঁদের উপস্থিতি, ‘মাজা ও দোহতা’ কনসেপ্টের মধ্য দিয়ে শরীর ও আত্মার দ্বৈতাদ্বৈতবাদ—মুরাকামির এ উপন্যাস অঙ্কিত হয়েছে কল্পনার এক বিস্তৃত বুনো প্রেক্ষাপটে।

ঝঞ্ঝামুখর পৃথিবীতে পরাক্রমশালী এক উগ্র ধর্মীয় গ্রুপের সঙ্গে লড়াইয়ে আওমামে আর ট্যাঙ্গো যে বেঁচে বেরিয়ে আসতে পারে, তার কারণ তারা একে অপরকে পুরোটা হৃদয় দিয়ে ভালোবাসা। মুরাকামি এ উপন্যাসে নায়িকা আওমামের মুখ দিয়ে তার প্রেম সংক্রান্ত দর্শন বলিয়ে নেন— “Should you can love somebody along with your complete coronary heart, even one particular person, then there may be salvation in life. Even if you cannot get along with that particular person.”। কাউকে পুরো হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে পারলে, তোমার মোক্ষলাভের সম্ভাবনা আছে, যদি তোমার সে ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে কখনো মিলন নাও হয়। এটাই মোটের উপর এ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু, এবং টেক হোম অ্যাডভাইস।


এক হাজার পৃষ্ঠার ঊর্ধ্বে বহু আলোচিত উপন্যাস আছে পৃথিবীতে। তবে কালোত্তীর্ণ সুবিশাল এসব উপন্যাস নির্মিত বিচিত্র সব চরিত্রের উপস্থিতিতে এবং নানারকম ঘটনার ঘনঘটায়। মুরাকামির এই ঢাউশ সাইজের উপন্যাসটি অন্যান্য বড় উপন্যাসের থেকে এই জায়গায় আলাদা যে— মুরাকামি হাতেগোনা তিনটি চরিত্রের বর্ণনায় (ট্যাঙ্গো—আওমামি ছাড়াও, উপন্যাসের শেষ দিকে উষিকাওয়া নামের এক গোয়েন্দার ভাষ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে) এত বড় উপন্যাসটি লিখেছেন। এবং, এত বড় উপন্যাসে ঘটনার ঘনঘটা তেমন নেই। ঘটনা ঘটে অল্প কিছু। তার প্রভাব বিবিধ লোকের মননে— মস্তিষ্কে কীভাবে পড়ে, মুরাকামি সেটাই অঙ্কিত করেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।

মুরাকামি তার প্রতিটি নতুন উপন্যাসে ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করতে ভালোবাসেন। তার প্রতিটি কাজ তাই এক হিসেবে নিজের আগের কাজকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই। 1Q84 উপন্যাসের ব্যাপারে মুরাকামি বলেছিলেন, তার সর্ববৃহৎ আঙ্গিকের এ উপন্যাস ছিল নিজের প্রতি ছুড়ে দেয়া এক চ্যালেঞ্জ, যা তার নিজের বিবেচনায় তিনি কোনোক্রমে টেনেটুনে উতরে গেছেন। তবে মুরাকামির জগতের অনুরাগী পাঠকের কাছে উপন্যাসটি মুরাকামির অন্যান্য উপন্যাসের মতোই এক উপহার; ভিন্ন—অপরিচিত এক জগতের প্রবেশদ্বার।


👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Uncomm

Share
Published by
Uncomm

Recent Posts

That is the POCO X7 Professional Iron Man Version

POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…

6 months ago

New 50 Sequence Graphics Playing cards

- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…

6 months ago

Good Garments Definition, Working, Expertise & Functions

Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…

6 months ago

SparkFun Spooktacular – Information – SparkFun Electronics

Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…

6 months ago

PWMpot approximates a Dpot

Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…

6 months ago

Keysight Expands Novus Portfolio with Compact Automotive Software program Outlined Automobile Check Answer

Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…

6 months ago