Categories: Bangladesh News

‘মুজিববাদী ফ্যাসিস্ট’  সংবিধানের প্রতি হাঁটুগাড়া শ্রদ্ধা!


আজ বাংলাদেশের সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে মূল সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল বলে এই দিন সংবিধান দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভাগ্য ভালো যে এই সংবিধানটি এখনও ‘খাড়া’ আছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সুশীল, সাবেক বিচারপতি ও কোনও কোনও বিভ্রান্ত বাম তাত্ত্বিক রব তুলেছেন যে বাংলাদেশের মূল সংবিধান ‘মুজিববাদী ফ্যাসিবাদ’ আক্রান্ত; ফলে সংবিধান পুনরায় লিখতে হবে অথবা এটি ফেলে দিয়ে আস্ত একখান নতুন সংবিধানের মুসাবিদা করতে হবে। যেন ‘মামুর বাড়ির আবদার’! অথবা ‘বাচ্চা পোলাপানের ইচিং-বিচিং খেলা’! ইচ্ছে হলো আর ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিলাম। তারপর বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি, সুশীল ও বাম হঠকারীদের কথায় লিখে ফেললাম নতুন সংবিধান। যারা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন, তাদের কি এটা করার বৈধ এখতিয়ার আছে? তারা কি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েছেন? তারা কি রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি, শিক্ষক, আইনজীবী, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ সব শ্রেণি-পেশা ও লিঙ্গের মানুষ, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের মতামত নিয়েছেন? যদি না নিয়ে থাকেন, তাহলে সংবিধানের একটি অক্ষর স্পর্শ করার এখতিয়ারও তাদের নেই, পুনর্লিখন তো বহু বহু দূরের কল্পনা। 

এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, যার তুলনা ইতিহাসে বিরল; সেই মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব, মুক্তিযুদ্ধের ফসল সংবিধান নিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় কুতর্ক তোলা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। কাতালোনিয়া, কাশ্মির, উত্তর আয়ারল্যান্ড, বেলুচিস্তান, কুর্দিস্তানসহ কত কত প্রদেশ বা স্থানের কত কত স্বাধীনতাকামী ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বছরের পর বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করে এখনও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি; অথচ ৯ মাসের একটি জনযুদ্ধের মাধ্যমে প্রবল পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চাট্টিখানি বিষয় ছিল না। কেননা, পাকিস্তানের সমর্থনে তখন ছিল বৈশ্বিক মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সমর্থনও পায়নি। বিশ্বের ইতিহাসে বাঙালিদের এমন বিরল এক অর্জনকে আজ কৌশলে প্রশ্নবিদ্ধ করে অবান্তর করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।

তবে ইতিহাস সাক্ষী, যারা মুক্তিযুদ্ধকে অবান্তর করার চেষ্টা করছেন, অল্প কিছু দিনের মধ্যে তারা নিজেরাই অবান্তর হয়ে যাবেন।

যারা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন, এটি করার বৈধ এখতিয়ার তাদের আছে কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রশ্নটির জবাব পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মূল সংবিধান কাদের দ্বারা এবং কী প্রক্রিয়ায় রচিত ও গৃহীত হয়েছিল, সেটি জানা দরকার। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনসহ সর্বমোট ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগরে আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসন লাভ করে। ফলে প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনসহ আওয়ামী লীগরে দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি।

৭০-এর নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছিল ঐতিহাসিক ৬ দফার জন্য; যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল– তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক স্বাধিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের নির্বাচিত সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানেরা তাদের সেনাবাহিনীর মাধ্যমে যখন জেনোসাইড শুরু করলো, তখন শুরু হলো বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে জনগণের পক্ষ থেকে সংবিধান রচনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হলো গণপরিষদের ওপর। 

১৯৭০ সালরে ৭ ডিসেম্বর এবং ১৭ জানুয়ারি যথাক্রমে পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪০৩ জন এমএনএ এবং এমপিএ নিয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের গণপরিষদ, যেটি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অস্থায়ী সংসদ হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের সংবিধান রচনা কমিটি গঠন করা হয়।

এই কমিটির সদস্যরা একটি খসড়া সংবিধান তৈরি করেন, যেটির ওপর আলোচনা হয় এবং বেশ কয়েকটি সংশোধনী গ্রহণ করার পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। ইতিহাসের এই বয়ানটি তুলে ধরার কারণ হলো, ১৯৭২ সালে যারা সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন তারা ছিলেন জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থনে সমর্থিত। দ্বিতীয়ত, এই সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য ড. কামালের নেতৃত্বে আইনজীবী ও গণপরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি দক্ষ দল গঠন করা হয়েছিল। তৃতীয়ত, খসড়া সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়েছিল। ফলে, একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনগণের যে ম্যান্ডেট এবং আইনের যে পদ্ধতিগত শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, সেগুলো বাংলাদেশের মূল সংবিধান প্রণয়নের সময় পূরণ হয়েছিল। এছাড়া মান ও বিষয়বস্তুর বিচারেও এটি ছিল একটি আদর্শ সংবিধান। এবার সংবিধানের বিষয়বস্তুর দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। 

১৯৭২ সালের সংবিধানের মুখবন্ধের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা– যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য, ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হইবে…”। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুখবন্ধে যে কথা বলা হয়েছে, একটি রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে মহত্তর উদ্দেশ্য আর কি হতে পারে? বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হবে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল মানুষের জন্য আইনের শাসন থাকবে এবং সকলের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। আরও বলা হয়েছে ন্যায়বিচারের কথা, যে ন্যায়বিচার হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক। 

এখন কথা হচ্ছে, যেসব শিক্ষার্থী জুলাই-আগস্টে আন্দোলন করেছেন, তাদের মূল দাবি ছিল বিসিএস চাকরিতে বৈষম্য নিরসন। পরবর্তীতে সেই আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে সরকারের এবং রাষ্ট্র সংস্কারের গণ-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বস্তুনিষ্ঠ বিচারে বাংলাদেশ সংবিধানের মুখবন্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, সেটি ভাষা আন্দোলন এবং ৬৯ থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ৩টি গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার চেয়েও বড়; শুধু বিস্তৃতিতে নয়, চেতনা ও আদর্শের বিচারেও মহত্তর। ৭২ সালের মূল সংবিধানকে যারা ‘মুজিববাদী ফ্যাসিস্ট’ সংবিধান বলছেন, তাদের বেশিরভাগের সংবিধান সম্পর্কে কোনও পাঠ নেই; কেননা, তারা সংবিধান থেকে এর সমর্থনে কোনও অনুচ্ছেদ দেখাতে পারবেন না।

মূল সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে “জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, চিন্তা ও বাকস্বাধীনতা, সভা ও সমাবেশ করার অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার, সম্পত্তির মালিক হবার অধিকার, গ্রেপ্তার ও দণ্ড থেকে সুরক্ষা, সুবিচার পাওয়ার অধিকার। এই অধিকারগুলো ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাসহ ১৯৬৬ সালে গৃহীত দুটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, মানুষের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে এযাবৎ যেসব চিন্তা ও দর্শনের বিকাশ ঘটেছে তার নির্যাস লিপিবদ্ধ হয়েছে মূল সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির মধ্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, মালিকানার নীতি, জাতীয় জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন।

আমার মূল আপত্তিটি সংবিধানের পুনর্লিখনের ব্যাপারে, সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে নয়। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারসহ শক্তিশালী গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য যে সংশোধনী দরকার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সেটি করতে পারবেন। যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ‘মোটিভ’ নিয়ে যারা মূল সংবিধানকে ‘মুজিববাদী ফ্যাসিস্ট’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে প্রবলতরভাবে দ্বিমত করে বাংলাদেশের আদর্শ সংবিধানের প্রতি রইলো আমার হাঁটুগাড়া শ্রদ্ধা।   

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।       

 


👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Uncomm

Share
Published by
Uncomm

Recent Posts

Rubidium Stabilises Laser For Quantum Know-how

- Commercial - Researchers at UC Santa Barbara have engineered compact, low-cost lasers matching lab-grade…

4 hours ago

Memes, Jokes and Cats: South Koreans Use Parody for Political Protest

As South Koreans took to the streets this month demanding the ousting of their president,…

18 hours ago

2024 Wrap Up: The place Are We with Development Security?

Is building security a precedence at your organization? There was an evolution that has occurred…

18 hours ago

This is all the things we count on and need from smartwatches and good rings in 2025

Sunday Runday(Picture credit score: Android Central)On this weekly column, Android Central Wearables Editor Michael Hicks…

18 hours ago

সবকিছু ঠিক থাকলে ২৯ ডিসেম্বর লন্ডন যাত্রা করবেন খালেদা জিয়া

শারীরিকভাবে নতুন কোনও সমস্যা উদয় না হলে আগামী ২৯ ডিসেম্বর (রবিবার) লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ…

19 hours ago

Photo voltaic MPPT Charger Reference Design

The photo voltaic charging reference design makes use of MPPT to enhance power use for…

23 hours ago