Categories: Bangladesh News

বৈসাবি, পাহাড়ের নববর্ষ ও পাহাড়ের রাজনীতি


আজ বাঙালিদের স‍‍র্বত্র, দেশে এবং বিদেশে, বাংলা নব‍বর্ষ উদযাপন হলেও পা‍র্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালি-ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্তাগুলোর জীবনে ও সমাজে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছে আরও দুইদিন আগে থেকে।

পাহাড়ের জাতিসত্তার মানুষে নববর্ষ উদযাপন করে তিন দিন: চৈত্রের শেষ দুইদিন এবং বৈশাখের প্রথম দিন। তিন দিন ব্যাপী এ উৎসব পাহাড়ের স‍‍র্বত্র একটা জমজমাট উৎসবের আমেজ তৈরি করে। বিভিন্ন রকম এবং পদের খাওয়া তৈরি করা হয়। ভোজন এ উৎসবের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। পুরনো বছরের জরা, জী‍র্ণতা, ব্যর্থতা এবং অন্ধকারকে দূরীভূত করে নতুন বছরের জন্য নানান প্রা‍র্থনা, অর্চনা, কামনা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাহাড়ের স‍‍র্বত্র নবব‍‍র্ষের উৎসব শুরু হয় এবং নানান আচার, আনুষ্ঠানিকতা ও রীতির অনুসরণের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে নববর্ষ উদযাপিত হয়।

যখন গোটা বাংলাদেশ এবং বিদেশেও, জুড়ে বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখের উৎসব চলে, তখন পা‍র্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ পালন করে তাদের নিজস্ব নবব‍‍র্ষের উৎসব যাকে পাহাড়ের বাইরের জগতের মানুষ নামকরণ করেছে “বৈসাবি”।

পাহাড়ের সমাজ, পাহাড়ের সংস্কৃতি, পাহাড়ের ইতিহাস, পাহাড়ের ঐতিহ্য, কৃষ্টিকলা, পাহাড়ের নানা রীতিনীতি এবং পাহাড়ের স্বতন্ত্র রাজনীতিকে গভীরভাবে উপলব্ধি না-করলে কখনোই “বৈসাব”র ভেতর দিয়ে পাহাড়ের নববর্ষ উদযাপনের মর্মার্থ উপলব্ধি করা যাবে না। কেননা, বৈসাবি বলে আলাদা কিছু নাই। এবং বৈসাবি প্রকৃতপক্ষে কোনও একটি জনগোষ্ঠীর বা কোনও জনগোষ্ঠীরই নববর্ষ উদযাপনের কোনও নামই নয়। এমনকি বৈসাবি শব্দটির কোনও পাহাড়ের জাতিসত্তার দেওয়া কোনও নাম নয়। এটা পাহাড়ের বাইরে আলগা লোকের চাপিয়ে দেওয়া তকমা। অথচ  আমরা বেসুমার ভাবে এবং পাইকারি হারে পাহাড়ে নববর্ষ উদযাপনকে গড়পড়তা “বৈসাবি” উৎসব বলে চালিয়ে দিচ্ছি।

আমি অনেক বছর আগে পত্রিকান্তরে লিখেছিলাম– বৈসাবি পাহাড়ের জন্ম নেওয়া বা পাহাড়ের কৃষ্টি-কালচারের সাথে সম্প‍‍র্কিত কোনও শব্দ নয়, এটা হচ্ছে বাঙালিদের বানানো একটা খিচুড়ি প্রত্যয়। কেননা বৈসাবি হচ্ছে তিনটি শব্দের আদ্যাক্ষর নিয়ে বানানো একটা খিচুড়ি প্রত্যয়। ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে নেওয়া “বৈ”, মারমাদে সাংগ্রাই থেকে নেওয়া “সা” এবং চাকমাদের বিজু থেকে নেওয়া “বি” নিয়েই তৈরি হয়েছে বৈ+সা+বি।

খোদ বাংলাপিড়িয়া লিখেছে, “বৈসাবি  বাংলাদেশে তিন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি।” সুতরাং বৈসাবি কোনও একক জাতিসত্তার একটি স্বতন্ত্র অর্থবোধক শব্দ নয়, বরং তিনটি জনতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরুত্বের স্মারক হচ্ছে বৈসাবি। তাই এ বৈসাবি পাহাড়ে বসবাসরত রাষ্ট্র-স্বীকৃতি ১১টি জাতিসত্তার নিজস্ব নববর্ষ উদযাপনের সামগ্রিকতাকে এবং সা‍র্বজনীনতাকে কোনোভাবেই প্রতিভাত করে না। কেননা, খুমি, খেয়াং, ম্রো, লুসাই, পাংখোয়া, বম, তনচঙ্গা, এবং চাক জাতিসত্তারও নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভরপুর নিজস্ব নববর্ষ পালনের রীতি আছে। তাদের নিজস্ব ধরন, রূপ, রীতি ও বৈশিষ্ট্য আছে। আবার প্রত্যেক জাতিসত্তার নববর্ষেরও নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র নাম আছে। এবং এসব জাতিসত্তার নববর্ষ পালনের রীতি সবসময়স এবং সবকিছু চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা জাতিসত্তার মতো নয়।

ফলে, আমরা যখন বৈসাবি বলি, আমরা আদতে নিজের অজান্তেই পাহাড়ের সংখ্যালঘু বনাম সংখ্যাগুরুত্বের রাজনীতি, একের মধ্যে অন্যকে বিলীন করে ফেলার রাজনীতি, পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির প্রকৃত রূপ এবং বহুমাত্রিক সামাজিক অসমতার গ্যাড়াকলের মধ্যে ঢুকে পড়ি। বোঝে কিংবা না-বোঝ কিংবা বেশি-বোঝে আমরা পাহাড়ের ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রে ভাস্বর একেকটি জাতিসত্তার নিজস্ব নববর্ষ পালনের রীতি ‘পাহাড়ে বৈসাবি উৎসব’ বলে বাজারে চালান করে দিই। আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বহুবয়ানের বদলে কতৃত্ববাদি ও অধিপতিশীল একধরনের বয়ানের বানে ভাসতে থাকি। তাই বৈসাবি বৈসাবি করে যখন পাহাড়ের নববর্ষ উদযাপনের কথা বলছি, মিডিয়াতে পাইকারি উপস্থাপন করছি, তখন আমরা আদতে পাহাড়ি সংস্কৃতির একটি খণ্ডিত অংশকে উপস্থাপন করছি।

যারা ক‍রপোরেট কালচারের জোয়ারে নিজেদের ভাসাতে পেরেছে, তাদের কালচারকেই আমরা পাহাড়ি জাতিসত্তার কালচার হিসাবে মিডিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র করছি। আর যারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক, যারা খানিকটা ভৌগোলিকভাবেও প্রান্তিক, যারা ক‍রপোরেট কালচারের মুনাফামুখী অভিযানে বাইরের বলয়ে বাস করে, যারা ক‍রপোরেট দৃষ্টির বাইরের মেরুতে অবস্থান করে কিন্তু পাহাড়ের সংস্কৃতির মৌলিকত্বকে বহুলাংশে প্রতিনিধিত্ব করে, তারা বৈসাবি’র ধারণার মধ্যে নেই। “পাহাড়ে বৈসাবি উৎসব” জাতি খুচরা এবং পাইকারি বাজারজাতকরণে অনুপস্থিত। যেমন খুমি সম্প্রদায়ের চাংক্রাইন, খেয়াংদের সাংলান, ম্রোদের চাংক্রান কিংবা চাকদের সাংক্রান বৈসাবিতে জায়গা পায় না। বম জাতিসত্তার লোকেরা সাধারণত ইংরেজি নবব‍‍র্ষের বাইরে আলাদা করে নিজস্ব জাতিসত্তার কোনও নববর্ষ পালন করে না। তথাপি, বৈসাবি শব্দবন্ধের মধ্যে একধরনের ‘বাদ দেয়া বাদ’ (এক্সক্লুশনারি) এবং অন্তর্ভুক্তিবাদের (ইনক্লুশনারি) রাজনীতি আছে। আমরা বোঝে কিংবা না-বোঝে এসব রাজনীতির পুনরোৎপাদন করি। কেননা, বৈসাবি ১১ টি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মধ্যে কেবল তিনটি জাতিসত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং বাকি ৮ টি স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে বাদ দেয়।

যদিও তনচঙ্গা জাতিসত্তার নববর্ষ উৎসবকেও বিষু বলে যা ‘বি’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। তথাপি ৭টি জাতিসত্তার নববর্ষের উৎসবকে কেন পাহাড়ের উৎসবের বাইরে রাখা হবে।

এখানে এ কথা অনস্বীকা‍র্য যে, জাতীয় ও স্থানিক রাজনীতিতে ১১ টি জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, এসব পিছিয়ে পড়া জাতিসত্তার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, সমাজের ইতিবাচক বিকাশে এবং পাহাড়ের সামগ্রিক উন্নয়নে চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা জাতিসত্তার মানুষের অবদান অবিস্মরণীয়। যারা পাহাড়, পাহাড়ের রাজনীতি এবং পাহাড়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন যে, ঐতিহাসিকভাবে চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষ পা‍র্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে যে পরিমাণ কষ্ট-স্বীকার করেছেন, যে পরিমাণ সেক্রিফাইস করেছেন এবং যে পরিমাণ নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেছেন তা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়। অন্যান্য জাতিসত্তার সাধারণ মানুষও সেটা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদ ও কর্তৃত্ববাদের পাশাপাশি অন্যান্য পাহাড়ি জাতিসত্তার ওপর চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদের পাশাপাশি সুযোগ ও সম্ভাবনার দখলদারিত্বও সাধারণ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে এক ধরনের বঞ্চনার অনুভূতি তৈরি করেছে।

১৯৯৭ সালে পা‍র্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এ বঞ্চনার বোধ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। তাই পা‍র্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের মধ্যকার বিদ্যমান সামাজিক স্তরবিন্যাস, অসম ক্ষমতার সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকারান্তরে প্রতিভাত করে যখন পাহাড়ে নববর্ষ পালনের নিজস্ব সাংস্কৃতির স্বাতন্ত্রবোধকে “বৈসাবি উৎসব” বলা হয় কেননা “বৈসাবি”র ধারণা শুধু চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিকেই প্রতিনিধিত্ব করে।

এটাই ‘বাদদেয়াবাদের রাজনীতি’। মনে রাখা জরুরি, পা‍র্বত্য চট্টগ্রাম মানে কেবল চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা নয়। পা‍র্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার নববর্ষ উদযাপন মানে “বৈসাবি উৎসব” নয়। পাহাড় মানে চাকমা, মারমা, এবং ত্রিপুরার পাশাপাশি খুমি, খেয়াং, লুসাই, পাঙখোয়া, ম্রো, চাক, বম ও তনচঙ্গাও। কেবল “বৈসাবি” নয়, পাহাড়ের সকল জাতিসত্তার পক্ষ থেকে সবাইকে পাহাড়ি নবব‍‍র্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।           


👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com

Uncomm

Share
Published by
Uncomm

Recent Posts

That is the POCO X7 Professional Iron Man Version

POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…

9 months ago

New 50 Sequence Graphics Playing cards

- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…

9 months ago

Good Garments Definition, Working, Expertise & Functions

Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…

9 months ago

SparkFun Spooktacular – Information – SparkFun Electronics

Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…

9 months ago

PWMpot approximates a Dpot

Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…

9 months ago

Keysight Expands Novus Portfolio with Compact Automotive Software program Outlined Automobile Check Answer

Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…

9 months ago