ধূলি-ওড়া খড়খড়ে প্রকৃতির মাঝে বাওকুড়ানির ঘূর্ণি-নৃত্য দেখে আমরা বুঝতে পারতাম বাংলা নববর্ষ সমাসন্ন। বারুণীর মেলার হাতি-ঘোড়া-মসজিদ-মঠ-মন্দিরের চিনির সাজ খেয়ে আমরা মুখঠোঁট চ্যাটচ্যাটে করে ফেলেছি। মরিচ ফুলের মতো পাপড়ি ছড়ানো বিন্নী ধানের খই ধামার তলানীতে নেমে এসেছে। বিন্নীর খই ঘন দুধে ফেলে শবরীকলায় মেখে খাওয়া সারা। আর চাক্কা লাগানো নিষ্প্রাণ ঘোড়াগুলি ঘরঘর করে ছুটছে। ছুটছে নাকি ওদের গলায় রশি বেঁধে আমরাই টানছি? দুই-একটা টেপাপুতুল এসেছে আমার জন্য। কারণ অন্য যারা আছে ওরা সকলেই পুত্র। কন্যা বলতে আমিই একা। বারুণীর মেলা থেকে চাক্কাওয়ালা ঘোড়াদের খুরের শব্দ আমাদের বাড়ির এ মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
এ বাড়ির পুত্রগণ ভারি দস্যি! কাঁচামিঠা আমগাছের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দিনমান। সুযোগ পেলেই ইটপাটকেল ছুঁড়ে কড়াআম পেড়ে আনে। এ নিয়ে পশ্চিমের শরীকেরা মহাবিরক্ত আমার ভাইদের প্রতি। তারা জোরেসোরে বলে, ঝুণ্ডির পালের জন্য আর বাঁচা গেলো না। গাছের আম বড় হইতেও দেয় না এরা!
ঝুণ্ডির পালের পরনের ইংলিশ-প্যান্টে থাকে ঝিনুকের ছুরি। এই ছুরি দিয়ে পাতলা পাতলা করে কড়াআম কেটে খাওয়া যায়।
টেপাপুতুলের ঝাকা মাথায় নিয়ে এখনও ঘোমটা-টানা হতদরিদ্র কিষাণীরা আমাদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে নাই। আর মাসখানেক পরই ঘনঘন আসবে ওরা। টেপাপুতুলের সম্ভার থেকে আমার দিদি (দাদীকে দিদি বলতাম আমরা) বেছে বেছে পুতুল কিনবে। ঢক-নকশা দেখে। এসব পুতুল বিক্রি-বাট্টা হয় পাকা আমের বদলে। দুই-তিন পয়সা নেওয়ার চাইতে ওরা পাকাআম নিতেই ভালোবাসে। দিদিকে বলে, মাজান, ঘরে পাকাআম থাইকলে তাই দুইডা দ্যান, পয়সা নিবার চাই না। দিদি ইতস্তত করে বলে, আম নিবার চাও তা নিওনি, পয়সাও নেও।
এরা ঝাকা মাথায় বাড়িতে ঢুকলেই বউঝিরা গোল হয়ে ঝাকার পাশে বসে যায়। মাটির সরা, মালসার দরদাম করে। সংসার, জীবনের জন্য তৈজসপত্র এদের কাছ থেকে অনায়াসেই ক্রয় করা যায়। কেউ কেউ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পোক্ত করার লক্ষ্যে কিনে ফেলে মাটির ব্যাংক। এসব ব্যাংকের আবার নানান আকৃতি, নানান চেহারা। কেউ কেউ ফলফলাদির রূপ ধরে ঝাকার মাঝে হেসে রয়েছে। আতাফল, আম, কাঁঠালের আকৃতির মাথার দিকে সামান্য করে কাটা। যেনবা কেউ সন্তর্পণে ব্লেড দিয়ে টেনে গেছে রেখা। এই রেখা গলিয়ে সিকি-আধুলি ফেলে রাখলে হাত টানাটানির সময়ে বেশ সহায় হয়ে ওঠে।
বাড়ির সামনে আমাদেরই বিস্তীর্ণ জমিন। আমাদের মানে সওদাগরদের অন্য শরীকের। ওতে নাইল্লাশাকের কঁচি কলাপাতারঙ ঝলমলিয়ে উঠেছে। পহেলা বৈশাখে খাওয়া হবে এই শাক রান্না করে। শুধু পাট গাছের চারার আগামাথার-পাতাগুলি রসুন, পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ যোগে। সঙ্গে সরিষার তেলে শুকনা-মরিচ বাদামী করে ভাজা, নতুন কাঁচা পেঁয়াজ আর কলুদের বাড়ি থেকে আনা কাসুন্দির ঝাঁঝালো ঘ্রাণে। চৈত্রের রোদ পাওয়া পোক্ত বেগুন লাকড়ির চুলায় পুড়িয়ে ভর্তা। আহা! এর কাছে অমৃতও হার মেনে যায়!
আর দিদি সদাই উৎকণ্ঠিত, ঝড়বাদলা এল নাকি? পশ্চিমাকাশে কালোমেঘ ঘনিয়ে উঠলো নাকি? পয়লা বৈশাখে কালবৈশাখী হবে না তাই কী হয়? ঝড় না এলে কীভাবে বোঝা যায় যে এসেছে নতুন বছর?
‘পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;
তরুশ্রেণী চাহে, পাখা মেলি
মাটির বন্ধন ফেলি
ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা,
আকাশের খুঁজিতে কিনারা।’
(বলাকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
হন্তদন্ত হয়ে দিদি প্রায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে বাড়ির এমাথা তে ওমাথা। বাঁশের আড়ে ঝুলছে কিনা মেলে দেওয়া কাপড়চোপড়? ঝড় এলে পলকেই উড়ে যাবে চোখের আড়ালে। দিদির মুখে তাই শঙ্কা। ঝড় এলেই কলেমা পড়তে শুরু করে সে- লা ইলাহা ইল্লালাহু…
দিদির কলেমা শুনে আম্মাচাচিরাও বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ায়। অথচ আমার কিনা ঝড় ভারি ভালো লাগে। একথা কাউকে বলাই যাবে না। আহা! ঝড়। বাতাসের মুহুর্মুহু আঘাত! আহ! কী তার দোর্দন্ড প্রতাপ! এল কি সব ম্যাসাকার করে দিলো। আমি দেখি আমগাছের ডালপাতা একবার এদিক যায়, আরেকবার ওদিক। কামরাঙাগাছ কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে আরও সবুজ হয়ে ওঠে। কলাগাছের পাতাগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে বিয়ে বাড়ির ঝালরের মতো ঝুলতে থাকে।
তীব্র ঝড়ের মাতমে নারিকেল গাছ যেন উড়তে থাকে মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে। আহ! কী দারুণ দৃশ্য! মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে! যেন চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাওয়া সেলুলয়েড ফিতা!
আমার ঝড় ভালো লাগে। (তাই বোধকরি কালবৈশাখীর খপ্পরে পড়া এমন এক জীবন টেনে নিয়ে গেলাম!) ঘরের সামনে ফুটে থাকা সন্ধ্যামালতির ঝাঁড় লন্ডভন্ড হয়ে যায় এই তুমুল ঝড়ে। আর ভিজে মাটিতে খালি পায়ে হেঁটে গেলে কী যে এক প্রশান্তির অনুভূতি! শান্ত হয়েছে প্রকৃতি। শীতল হয়েছে ধরিত্রী। আর আমিও।
‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক।
এসো এসো…’
ঝড়ের পর বেলগাছের তলায় গেলে হলুদাভ রঙের বেল পাওয়া যায়। বাতাসের তীব্রতা সইতে না পেরে পক্ববিল্ব খসে পড়েছে বোঁটা থেকে। কী সোয়াদ এসব বেলের! যেন নরমকোমল মাখন গলে যাচ্ছে মুখের ভিতর!
চড়া রোদ্দুরের মাঝেও কেমন অপরূপ স্নিগ্ধতা! যে দ্যাখে, সে দ্যাখে। যে অনুভব করে, সে করে। বাতাসে উড়ে বেড়ায় ঝড় আর বৃষ্টির পূর্বাভাস। আর দিদি ছুটে যায় বাইরবাড়িতে। পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ জেগে না উঠে কালো কিম্ভুতকিমাকার ভাল্লুক হামাগুড়ি দিতে শুরু করলো নাকি? তাহলে কালবৈশাখী অনিবার্য।
এদিকে আমি কিনা ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি:
‘ওগো বৈশাখী ঝড় লয়ে যাও লয়ে যাও
অবেলায় ঝরা এ মুকুল
লয়ে যাও আমার জীবন
এই পায়ে দলা ফুল।’
(কাজী নজরুল ইসলাম)
২.
শহরে বসবাস করতে এসে দেখি পশ্চিমের মেঘে নয়, সোনার সিংহ জেগে ওঠে কিনা পূবের মেঘে! আকাশের লালিমা মুছে যাওয়ার আগেই শুরু হয় সুরের ডালি সাজিয়ে বর্ষবরণ। বিশাল বটবৃক্ষের শাখাপত্রের তলায় বেজে ওঠে বীণা। বেজে ওঠে সেতার আর তানপুরা। ছড়ায় মূর্ছনা। ধনেখালি শাড়ি পরে খোঁপায় বেলফুলের মালা দিয়ে আমিও অংশীদার হতে যাই সেইসব সুরের।
‘আমার সুরের ইন্দ্রধনু
রচে আমার ক্ষনিক তনু
জড়িয়ে আছে সেই রঙে মোর
অনুরাগ অমিয়
আমার কথার ফুল গো
আমার গানের মালা গো
কুড়িয়ে তুমি নিও
আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়…।’
আহা! কীসব দিন! যেন পরতে পরতে কুহক! থরে থরে ফুটে ওঠা গন্ধরাজ আর বেলি! কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরানো পথে হেঁটে যেতে যেতে প্রেমের নামে রক্তাক্ত হওয়া! তবুও কিনা কৈশোরের মন চায় তাকেই, যে দেয় বিষভান্ড! যে দেয় দাহ আর অপমান!
তবুও প্রেমময় সেসব ভোর ছিল শান্তির পায়রা ওড়ানো। কী স্নিগ্ধ চারপাশ! প্রেমিক ও অভিজাত মানুষের দল বসে-দাঁড়িয়ে, শুনছে সেসব গান। পরনে লালপেড়ে গরদের শাড়ি। পাশের পুরুষের পরনে গরদ-পাঞ্জাবি। আমরা জনাকয়েক ধনেখালি আর টাঙ্গাইল পরে মুগ্ধ হয়ে ভোরের সংগীত শুনতে যেতাম। পায়ে আলতা। কপালে সিঁদুরের টিপ। আমাদের যখন-তখন জাত যেতো না কিছুতেই। এত অল্পতেই ভেঙে পরতো না ধর্মের কল। কারণ কোনো ধর্মই তখন কাচ দিয়ে মুড়ে রাখা হতো না। ধর্ম ছিল অনায়াস, পরনের বস্ত্রের মতো মোলায়েম ও একান্ত নিজের। কোনো জাহিরীপণা না করেও ধর্ম ছিল আমাদের বুকের ভিতর। একান্ত আপনার হয়ে।
কী অসম্ভব সুন্দর ছিল দিনগুলি! পুলিশের ব্যারিকেডে শুনতে হতো না ছায়া-সুনিবিড় সেই প্রভাতসংগীত। সবই ছিল উদার ও আনন্দের। নত ও সহনীয়। একে অপরের পরিপুরক।
গান শোনা শেষ হলে আমরা ঢুকে পড়তাম বৈশাখী মেলায়। মাটির কাপ-পিরিচ, দুই-একটা তৈজসপত্র, টেপাপুতুল কিনে ঘরে ফেরা। কিংবা একটা ছোট্ট ডুগডুগি বা মাটির-বেহালা। আর অবশ্যই বাঁশের সুচিক্কণ বাঁশি।
‘আমার অনেক বাঁশের বাঁশি আছে,
মিছে কেন কিনবি চাটাই বাঁশ।
আমি বারী বাঁশুরিয়া
বাঁশি যে মোর প্রাণপ্রিয়া
তা না হলে বাঁশির ভেলায়
ভাসাইয়া দে লাশ…।’
এই গানটিও তখন পর্যন্ত অশ্রুত ছিল আমাদের। এই গানের স্রষ্টাকে চিনি নাই কেউই, জানি নাই তখনও তেমন করে। এই যে সারাদিনমান সুরের পেছনে ঘুরছি। ঘুরে-ঘুরে ‘গীতালি’, ‘গানের ডালি’ করছি। হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছি হাতিরোডে। টিডিকে ক্যাসেটে গানবন্দী করছি। রেকর্ড প্লেয়ারে ফিতে জড়িয়ে গেলে ঢিপঢিপ করছে বুক- ইস্ কোন গানটাই না খোয়া যায় এইবার?
তখনো আবিষ্কার হন নাই এই বাঁশুরিয়া। আমরা তখন শুনছি সুমন:
‘বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি দেখি না তোমায়
গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় শহুরে হাওয়ায়।’
আমরা মুগ্ধতার ঢেউয়ে চুরচুর হয়ে যাচ্ছি! আমাদের আপাদমস্তক কেঁপে উঠছে নাগরিক কবিয়ালের সংগীতে:
‘আমি নাগরিক কবিয়াল, করি গানের ধর্ম পালন
সকলে ভাবছে লিখছে সুমন, আসলে লিখছে লালন’
বারী-বাঁশুরিয়াকে যখন চিনলাম, জানলাম, শুনলাম- তাঁর সুরও হৃদয়ে জড়িয়ে গেল কতই-না অনায়াস ভঙিমায়! নাগরিক কবিয়ালকে চেনাজানার কালেও কিন্তু আমদানী হয় নাই কোনো অচেনা-বৈশাখ! এই পান্তাইলিশ-কালচারের আগ্রাসন এমন দাপট বিস্তার করতে পারে নাই। এই কম্বিনেশন কে বা কারা করেছে সে ইতিহাস আমি জানি না। জাতীয় মাছের সঙ্গে কৃষকের ইজি-ব্রেকফাস্ট পান্তার যোগসাজশ এক বিরল ঘটনাই বটে! জাতীয় মাছ এই জাতি তো আজ চেখেও দেখতে পারে না- এতটাই আকাশচুম্বী দাম তার!
তাহলে কী হইলো? পান্তাভাতে ঘি খাওয়ার মতো করেই এই আয়োজন সম্পন্ন হইলো কিনা? বৈশাখের এই বাবুয়ানা রূপটিও দেখতে হলো ইহজীবনে! অথচ বারুণীর মেলা থেকেই শুরু হতো নতুনের আবাহন, আমাদের মাটির ঘোড়ার চাক্কাগুলি ভাঙচুর করে তারই এক্সটেনশন হয়ে উঠলো উচ্চবিত্তের ইচ্ছেঘুড়ির এক ঝা-চকচকে বৈশাখ! এবং সহজ মানুষের সহজ সাধ্যের বাইরে পান্তাইলিশের যুগলবন্দী! কোনো এক বৈশাখে প্রভাতসংগীতের আসরে বোম্ব-ব্লাস্ট হওয়ার পর থেকে আমি আর যাইনি ওই নিবিড় বটের ছায়। আমার রুদ্ররূপ ভালো লাগে না। আমার মেকি কিছুও ভালো লাগে না। ভালো লাগে না বলে কতকিছুই তো ছেড়ে দিয়েছি, কেই-বা সেসবের খোঁজ রাখে? আর খোঁজ রাখারইবা দরকার কী?
যায় দিন ভালো, আসে দিন মন্দ- এমনও হতে পারে পান্তাইলিশ থেকে ইলিশ মাছটি লম্ফ দিয়ে পালিয়ে যাবে ভরা নদীতে। আর তার স্থান পূর্ণ করবে স্যামন, ডরি বা ম্যান্ডারিন এসে। আমাদের নাতিপুতির দল পান্তভাত কাঁটাচামচে মুখে তুলে খেতে খেতে বলবে, এইঠা কী রাইস? ওয়াটার বেশি হইয়া গেসে। ফর্ক দিয়া খাওয়া যাইটেসে না, গ্র্যানি।
কী জানি! ভবিতব্য কে বলতে পারে? যাই-ই হোক না কেন, যে বা যা-ই আসুক না কেন সৈনিক প্রস্তত আছে! প্রস্তুত হও। প্রস্তুত! ডাইনে ঘুরো! কিংবা বামে! বৈশাখের খর-রোদ্দুরে মাথার চান্দি ফেটে যাবার আগেই তাই জানিয়ে দিতে চাই:
‘নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে॥
উৎসারিত নব জীবননির্ঝর উচ্ছ্বাসিত আশাগীতি,
অমৃতপুষ্পগন্ধ বহে আজি এই শান্তিপবনে…।’
👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com
POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…
- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…
Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…
Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…
Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…
Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…