Categories: Bangladesh News

জুলাই বিপ্লব, বুদ্ধিজীবী ও স্বীকার-অস্বীকারের রাজনীতি


সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী দাবি করেছেন, একাত্তর সালের দেশ স্বাধীন হওয়ার বিষয়টি যেমন এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেননি তেমনি সাম্প্রতিক সরকার পতনও তারা বুঝতে পারেননি। বুদ্ধিজীবী-চিন্তকদের হেয় করে কথা বলার ট্রেন্ড নতুন নয়। উপর্যুক্ত কথার প্রায় কাছাকাছি কথা নানা প্রেক্ষাপটে প্রায় হাজারবার শুনেছি। তাই তার ওই কথা আমার কাছে নতুন কিছু মনে হয়নি। বরং যারা এই ধরনের তাচ্ছিল্য দিয়ে কথা বলেন তাদের চিন্তার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বড় ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহায়তা করার কারণে তাদের অনেক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর, আলশামসরা হত্যা করে। সুতরাং একাত্তর সালে বুদ্ধিজীবীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেননি এমন দাবি বালখিল্য ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়।

বুদ্ধিজীবী, অ্যাকটিভিস্ট, রাজনৈতিক কর্মী ও জ্যোতিষীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ওই পার্থক্য বুঝতে না পারার কারণে উপর্যুক্ত মন্তব্য এসেছে বলে মনে করি। গ্রহ-নক্ষত্র দেখে দিন তারিখ সময় বলে দেওয়া জ্যোতিষীর কাজ। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর কাজ জ্যোতিষীর মতো দিন-তারিখ-সময় বলে দেওয়া নয়। বুদ্ধিজীবী বা চিন্তক কোনও ঘটনা ঘটলে তার ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করেন। তিনি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, অতীত ঐতিহাসিক ঘটনা পর্যালোচনা করে তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখান। কিন্তু তিনি যেভাবে বলেন সেভাবেই সব ঘটবে বিষয়টি এমন নয়। কারণ ঘটনা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়। ওই পরিবর্তনে তার কোনও হাত থাকে না, কারণ তিনি রাজনৈতিক কর্মী বা অ্যাকটিভিস্ট নন।

সদ্য নির্বাসিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবাদপত্রে ও গণমাধ্যমগুলো এক ধরনের সেন্সরশিপের মধ্যে ছিল। ভয়ের সংস্কৃতির কারণে লেখকরা সেলফ সেন্সরশিপ করতেন। উপরন্তু সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকীয় দফতর তার ওপর আবার কাঁচি চালাতেন। সুতরাং বাংলাদেশের লেখক-চিন্তক-বুদ্ধিজীবীরা যা চাইতেন তা-ই লিখতে পারতেন বিষয়টি এমন নয়। তাই সব বিষয় হয়তো তারা চাইলেও মন খুলে বলতে পারেননি। তারপরও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শেষের দিকে ড. সলিমুল্লাহ খানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা রাজপথে দাঁড়িয়ে সরকারের পতন চেয়েছেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন সদ্য নির্বাসিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই তারা ঝুঁকি নিয়ে এমন বক্তব্য দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মোহাম্মদ আজম, সামিনা লুৎফাসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের শিক্ষকরা রাজপথে ছিলেন। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে যেদিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেন সেদিনই সরকার পতনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হলেও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা অরাজনৈতিক ছিলেন না। সদ্য গঠিত নয়া শক্তি নামের রাজনৈতিক দলের সদস্যরা মূল নেতৃত্বে ছিলেন। এই বিষয়টি যারা জানতেন তারা এটাও বুঝেছিলেন সরকার ভুল করলে ওই অরাজনৈতিক মোড়কের আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে ধাবিত হতে পারে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকেই এই বিষয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়। সুতরাং কোনও কিছুই গোপনে হয়নি। প্রকাশ্যেই আন্দোলনের গতিপথ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। অবশ্য সরকার সেই বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।

জুলাই আন্দোলন চলমান থাকাকালীন আওয়ামী লীগের গবেষণা সেলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছিলেন এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। তিনি বল প্রয়োগের পক্ষে নানান যুক্তি তুলে ধরছিলেন। তার বক্তব্য শোনার পর আমি তাকে দুটি কথা বলেছিলাম: বল প্রয়োগ করলে সরকার যদি টিকেও যায় তাহলেও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। জনগণের মধ্য থেকে গণআন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের বল প্রয়োগের মাধ্যমে টিকে থাকার সিদ্ধান্ত হবে আত্মহত্যার শামিল। দ্বিতীয় কথা বলেছিলাম: বল প্রয়োগ করা হলে সরকারের টিকে থাকা কঠিন হবে, যার সম্ভাবনা প্রবল। তবে তিনি আমার কথা খারিজ করে দেন নানান যুক্তি দিয়ে। আমি তার মনস্তত্ত্ব বুঝে এই বিষয়ে আর কথা বাড়ায়নি। কারণ তিনি এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। তিনি ছাত্রনেতা হওয়ার কারণে ছাত্রজীবনে আলাপ-আলোচনার বদলে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে অভ্যস্ত ছিলেন। ওই মনস্তত্ত্বই তাকে অমন কথা বলার আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের এটাও একটি ব্যর্থতা ছিল যে তারা শেষ দিকে এসে শুধু জনবিচ্ছিন্ন হয়নি, তাদের চারপাশ ঘিরে রেখেছিল একদল চাটুকার। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা গণমাধ্যমগুলোতে গলা উঁচিয়ে কথা বলতো তাদের অধিকাংশের প্রধান লক্ষ্য ছিল চাটুকারিতা ও তেলবাজির মাধ্যমে সরকারের নজর কাড়া এবং সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়া। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে মাঠের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে প্রকৃত সত্য তারা কখনও বলেননি। আর তাদের ওই চাটুকারিতার পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। বিরোধী মত হলেও সবসময় অন্যকে কথা বলতে দেওয়ার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বোঝা যায়। কথা বলা বন্ধ করে চিন্তক বুদ্ধিজীবীদের গলা টিপে ধরে সাময়িক লাভ হলেও সত্য বিচ্যুত হতে হয়। সত্য বিচ্যুত হওয়ার মাশুল যে কত বড়, তা যুগে যুগে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগও সত্য বিচ্যুত হয়েছিল বলেই তাদের অপমানজনক পতন ঘটেছে।

বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসন্ন ছিল তা বেশ কয়েক বছর ধরে বোঝা যাচ্ছিল। বিশেষ করে ২০১৮ সালের একতরফা নির্বাচনের পরে তরুণ সমাজ পরিবর্তন চাইছিল। শাহবাগ, কাটাবন-কনকর্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তরুণদের সঙ্গে কথা বললে তা উপলব্ধি করা যাচ্ছিল। অল্প-স্বল্প হলেও তরুণরা সংগঠিত হচ্ছে তার গান আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল। কোটা আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা বলে যে তরুণকে গণমাধ্যম পরিচয় করে দিয়েছে সেই তরুণসহ অনেকের সঙ্গে আলাপে তাদের চাল-চলনে বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্বের বিষয়টি ফুটে উঠেছিল। যদিও তারা অতি গোপনে এই কাজ করছিল। সংগঠিত হচ্ছিল। কিন্তু সব কিছু যে তারা স্বাভাবিক ছন্দে করছে না তা বোঝা যাচ্ছিল।

একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে কার অবদান কত ছিল তা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছিল। ওই বিরোধের জের বাংলাদেশ আজও টানছে। অবদান অস্বীকার ও কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের রাজনীতির মাশুল বাংলাদেশকে বহু বছর দিতে হয়েছে। জুলাই বিপ্লব এখনও সফল নাকি ব্যর্থ তা বলার সময় আসেনি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন মুশতাক সরকার যে কয়দিন শাসন করেছিল তাও অতিক্রম হয়নি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বহিঃকূটনীতিক পরিস্থিতি বলছে, জুলাই বিপ্লব সফল নাকি ব্যর্থ তা এখন মূল্যায়নের সময় হয়নি। বিপ্লবীরা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বা খোমেনির মতো ইতিহাসে নিজেদের নাম লেখাবে নাকি তাদের পরিণতি কর্নেল তাহেরের মতো হবে সেই কথা বলার সময় এখনও হয়নি। এমন একটি অস্থির পরিস্থিতিতে চলছে স্বীকার-অস্বীকারের রাজনীতি।

কাউকে ছোট বা বড় করার আহাম্মকি দেশ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু বয়ে আনবে না বলে মনে করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

[email protected]


👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Uncomm

Share
Published by
Uncomm

Recent Posts

That is the POCO X7 Professional Iron Man Version

POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…

6 months ago

New 50 Sequence Graphics Playing cards

- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…

6 months ago

Good Garments Definition, Working, Expertise & Functions

Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…

6 months ago

SparkFun Spooktacular – Information – SparkFun Electronics

Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…

6 months ago

PWMpot approximates a Dpot

Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…

6 months ago

Keysight Expands Novus Portfolio with Compact Automotive Software program Outlined Automobile Check Answer

Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…

6 months ago