১৪তম পর্ব
সেই ‘পিশাচ আক্রান্ত দিন-রাত’
“নচিকেতা জরাথুষ্ট লাওৎ—সে অঞ্জেলো রুশো লেনিনের মনের পৃথিবী
হানা দিয়ে আমাদের স্মরণীয় শতক এনেছ?
অন্ধকার ইতিহাসে পুরুষের সপ্রতিভ আঘাতের মতো মনে হয়
যতই শান্তিতে স্থির হয়ে যেতে চাই;
কোথাও আঘাত ছাড়া—তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই।”—জীবনানন্দ দাশ
রঙিন বসন্তের পর তীব্র দাবদাহের গ্রীষ্ম। এই বসন্তের পরের প্রবল গ্রীষ্ম দিনে ভারতে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ২১ মাসের সে এক অন্ধকার আক্রান্ত সময়।
আমি তখন প্রাইমারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছি। পঞ্চম শ্রেণি। তখনো আমাদের দেশবন্ধুনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কো-এড, অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রী একসাথে। উদ্বাস্তু কলোনির স্কুল, ক্লাসরুমে মাথার উপর বৈদ্যুতিক পাখা কল্পনাতেও তখন আনা যায় না। জানালাগুলোতে কোনো গ্রিল বা পাল্লা নেই, স্বভাবতই পেছনের মাঠের সঙ্গে ক্লাস ঘরের মধ্যে এক লাফে আমাদের অনায়াস যাতায়াত খেলা হয়ে উঠেছিলো। পঞ্চম শ্রেণির দুই কক্ষ, মোট ছাত্র-ছাত্রী একশেরও উপর। আমার ‘বড়’ স্কুলে ভর্তির দিন সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন আমার ছোট কাকু। তিনি তখন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বাবা স্কুলের পরিচালন কমিটির সদস্য। স্কুলের হেড ক্লার্ক ধরণী ভট্টাচার্য, ময়মনসিংহের মানুষ, কথায় সেই টান। ছোট কাকা তাঁর হাতেই আমাকে তুলে দিলেন— ‘আপনি স্কুলে ওর অভিভাবক, প্রয়োজনে বেতের শাসনে রাখবেন’। তখন শিক্ষকেরা হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে যেতেন, করিডরে পাহারা দিতেন। একদিন আমার স্কুলে ঢুকতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ধরণীবাবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ‘হাত পাত!’ কোনো কথা নেই আর, এক–দুই-তিন ঘা। ক্লাস ঘরের দরজা দেখিয়ে বললেন— ‘যা, ক্লাসে যা, আর যেন মারতে হয় না’। ডান হাতের তালুর সেই দাগ মনে চিরকালের চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। স্কুলে, কলেজে সময়ের আগেই পৌঁছে যাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। ধরণী ভট্টাচার্য ছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে বিএ পাশ করে আসা ভূমিচ্যুত উদ্বাস্তু। দেশভাগের সময় ময়মনসিংহ থেকে এই ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণেরা জলপাইগুড়ি শহরের থেকে কিছুটা দক্ষিণে, হলদিবাড়ী-পঞ্চগড় সীমান্তের দিকের এক গ্রামীণ এলাকা তোড়লপাড়ায় আশ্রয় নেন। তিনি আমাদের উদ্বাস্তু স্কুলে ক্লার্ক হিসাবে কর্মরত থাকলেও উঁচু ক্লাসে ধরণীবাবু ইংরেজি ও অঙ্কের ক্লাস নিতেন। তোড়লপাড়া থেকে আমাদের স্কুল প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন সাইকেলে চেপেই স্কুলে আসতেন। বড় পরিবার তাঁর, এর রসদ যোগাতে স্কুল ছুটির পর শহরেই টিউশনি করিয়ে ফিরতেন। আমাদের ক্লাসের নতুন বন্ধু রূপকান্ত রায়ের বাবা ভূমিহীন খেতমজুর। বৃষ্টি নামলে কৃষকের কাছে ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে তাঁর চাষের জমি। ধান চাষের মরশুমে বেশিরভাগ দিনই রূপকান্ত ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতো। তখন সেদিন মজুর হয়ে কৃষি কাজ করতো, জমিতে লাঙল চালাতো। ধরণী বাবু তাঁকেও পড়াতেন। আমার খুব কাছের বন্ধু রূপকান্ত বরাবর ক্লাসে প্রথম হতো। পরে জেনেছি তাঁর পড়াশোনার যাবতীয় খরচ দিতেন ধরণী ভট্টাচার্যই। রূপকান্তের মা অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘর বেঁধে চলে যায়, কয়েক বছর পরে তারা ফিরে এসে ওর গ্রামেই থাকতো। ওর বয়স তখন আট বছর মাত্র। রূপকান্ত কয়েকদিন স্কুলে না আসায় একদিন বিকালে সাইকেল চালিয়ে ওর গ্রামে হাজির হই, হলদিবাড়ির কাছাকাছি নন্দনপুর। সেই সময় রূপকান্ত বাসায় ছিল না। ওর বাবার জ্বর, তাই তিনি সেদিন কাজে যান নাই। বাবা আমাকে বসতে বললেন। রূপকান্ত অনেকক্ষণ পরে ফিরলো। কোমরে গুটানো গামছা, রূপকান্তের গোটা শরীর জুড়ে কাদা ও মাটি, হাতে একটা কোদাল। ওর সেই মাটিমাখা জীবন্ত মূর্তি দেখে কি যা হলো আমার, দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। আমার হাতে, বুকে, জামায়, গালে কাদা-মাটি মাখামাখি। আমাকে বসিয়ে কুয়তলায় গেলো সে। স্নান করে এসে রান্নাঘর থেকে বাটিতে করে মুড়ি আর গুড় নিয়ে এলো। এরপর আমার ফিরে আসার সময় অনেকটা পথ সঙ্গে এলো। পিচ রাস্তায় উঠে সাইকেল চড়লাম, ও হাতটা আমার হাতে রেখে মায়াময় চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, আমার শরীরে ওর হাতে তখনও কাঁদা মাটির গন্ধ। হাতে হাত রেখে একটা কথা বললো রূপকান্ত, যে কথা আজও আমার মনে গেঁথে আছে— জানিস, প্রতিটা মুহূর্ত আমি আমার বাবার নিঃসঙ্গতা ছুঁয়ে দেখি আর আমার শরীরটা সেই আঁচে তেতে ওঠে। বাবারা কাঁদে না, তাঁদের চোখের জল জমে থাকে আত্মায়। বাবার একা কান্নার জল আমাকে ছুটিয়ে বেড়ায়।”
এরপর আমি স্কুল পালটে ফণীন্দ্রদেব স্কুলে ভর্তি হলে অত বড় ছেলেটাও বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলেছিলো, ধরণীবাবুও দুঃখ পেয়েছিলেন খুব। বছর দুয়েক পরে ধরণী বাবু একরাতে সাইকেলে করে বাসায় ফেরার সময় গাড়ি চাপা পরেন। স্পট ডেড। আরো অনেক মৃত্যুর মধ্যে একদিন এই মৃত্যুটিও হারিয়ে যায়। মাধ্যমিকে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করা রূপকান্ত রেজাল্ট বেরোনোর পর কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। অনেক হারিয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে অসফল রূপকান্তেরা হারিয়ে যায়।
নতুন স্কুলে আমার ‘ইউনিফর্ম’ হলো। খাকি প্যান্ট, সাদা জামা। পুলিশের খাকি উর্দির রং গায়ে নিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু হলো। বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার, হেঁটে যাতায়াত আমাদের। আমার নতুন স্কুল ফণীন্দ্রেদেবের প্রধান শিক্ষক সনৎ মজুমদার খুন হয়েছিলেন সত্তরের রক্তাক্ত সময়ে, নকশালদের হাতে। দিল্লী থেকে এসে স্কুলে যোগ দিয়ে তিনি মেস বাড়িতে থাকতেন। তেলিপাড়ার বসু বোর্ডিং তখন চাকুরে ব্যাচেলরদের আস্থানা। ১৯৭৩ এর জানুয়ারি, অন্যান্য দিনের মতো আনন্দমডেল স্কুলের সামনে দিয়ে ফণীন্দ্রদেব স্কুলে আসছিলেন। সেই সময় দুই কিশোর তাঁকে পথ আগলে ধরে চপারের কোপ দেয়, এরপর মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু হয়। ঘাতক দুজনেই কিছুদিন আগেও স্কুল ছাত্র ছিল, এদের একজন সুবিত আলি বর্ডার টপকে বাংলাদেশ পালিয়ে যায় বলে জানা যায়। এদের বয়স তখন মাত্র ১৫/ ১৬ বছর। ১৯৭২ সাল থেকেই জলপাইগুড়ি শহরের অধিকাংশ নকশাল নেতা হয় জেলে নতুবা গ্রামে আত্মগোপনে ছিলেন। শহরের নকশাল আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ কমবয়সীদের হাতে। এই সময় বীরভূম থেকে একজন নকশাল নেতা এখানে এসে আত্মগোপনে ছিলেন। জলপাইগুড়িতে তখন একে একে বেশ কয়েকজন নকশাল কর্মী নিহত হন। এক গোপন মিটিং-এ সেই নেতা দিল্লী থেকে আসা শিক্ষক সনৎ মজুমদারকে সরকারের ইনফর্মার হিসাবে চিহ্নিত করেন, এবং ‘দোষী’ সাব্যস্ত করে হত্যার নিদান দেন। এই হত্যাকাণ্ডের পর শহর জুড়ে শোক নেমে আসে এবং নকশালেরা আরো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গোটা দেশ জুড়েই তখন ক্রমশ অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন, ভারতবর্ষের ‘inside Disturbance’-এর অজুহাতে সংবিধানের ৩৫২ ধারা প্রদত্ত অধিকারবলে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শ ক্রমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ গোটা দেশে আভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করেন। এর ফলে ‘Civil liberties—to be suspended’। কারারুদ্ধ করা হয় শাসক বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। তখন এগারো-বারো বছরের কিশোর আমি রাজনীতি যে খুব বুঝতাম তা নয়, তবে দেশের আকাশে ঘনীভূত অশনি সংকেতের চিহ্ন আমাকে বুঝিয়েছিল রাষ্ট্র ও ক্ষমতার দাপটে স্বাধীনতার স্বপ্ন কীভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এই ‘বুঝতে পারা’ আরো তীব্র হলো যখন একদিন রাতে আমাদের সেই কাঠের সিনেমা হলটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। কালো পিণ্ড হয়ে যাওয়া সেলুলয়েডের রিল, ‘অশনি সংকেত’-এর পোড়া রিল ভর্তি ট্রাঙ্ক, পোড়া সাইনবোর্ড, পেনসিলের মতো কালো তামায় পেঁচানো কার্বন স্টিক…আরো কিছু সামগ্রী ট্রাকে করে বাসায় নিয়ে আসা হলো।
চলবে
👇Observe extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…
- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…
Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…
Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…
Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…
Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…