Categories: Bangladesh News

‘ঈদ যাত্রায় ভোগান্তি’ ও ‘দেশে’ যাওয়ার ঈদ আনন্দ


ঈদের সময় মানুষ, বিশেষ করে ঢাকা শহরের মানুষ, ‘দেশে’ যাবে, আত্মীয়, পরিবার ও পরিজনদের সঙ্গে একত্রে ঈদ করবে, এটা আমাদের ঈদের সংস্কৃতি। বছরে দুবার ঈদ এলে আমরা এ দৃশ্য দেখতে পাই। মানুষ নানান প্রয়োজনে, বিশেষ করে জীবিকার প্রয়োজনে, একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে বসবাস করে। তাই, ঈদের সময় তাদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা ‘দেশে’ চলে যায় ঈদ করতে। কারণ, ঢাকা অনেকেরই কাছে এখনও সত্যিকার ‘দেশ’ হয়ে ওঠে নাই। ঢাকা শহর এসব মানুষদের শ্রম নেয়, মেধা নেয়, সময় নেয় এবং সেবা নেয়। কিন্তু এসব মানুষদের আবেগ, অনুভূতি এবং ভালোবাসার পরিসর তৈরি করে না। তাই মানুষ ঈদ করতে ‘দেশে’ যায়। এখানে দেশ কোনও নি‍র্দিষ্ট সীমারেখায় বাস করা ভৌগোলিক প্রপঞ্চ নয়। এখানে ‘দেশ’ হচ্ছে সেটাই যেখানে বাবা-মা থাকে, পরিবার-পরিজন থাকে, আত্মীয়-স্বজন থাকে, বন্ধুবান্ধব থাকে, বেড়ে ওঠার অমলিন স্মৃতি থাকে, আলো-বাতাসের স্পর্শ থাকে, সিনার ভেতর আবেগের মধুর আবহ থাকে এবং যেখানে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা ও না-ফিরতে পারার কষ্ট থাকে। তাই, মানুষ ঈদ করতে ঢাকা ছেড়ে ‘দেশে’ যায়। প্রাণের টানে ‘দেশে’ যায়। নিষ্প্রাণ শহর ছেড়ে খানিকটা প্রাণের সন্ধানে ‘দেশে’ যায়।

কিন্তু প্রতি বছর ঢাকা ছেড়ে দেশে যাওয়ার পথে যে ভোগান্তি, কষ্ট এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়, সেটা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে খানিকটা জানতে পারি। ‘খানিকটা’ এ অর্থে বলেছি, কারণ মিডিয়া শুধু সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করে কিন্তু এই ভোগান্তি এবং কষ্ট যে কতটা তীব্র যে এ ভোগান্তির অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যায়, সেই কেবল বুঝতে পারে। সংবাদপত্রের সংবাদে বা টেলিভিশনের নিউজ আইটেমের ভেতর দিয়ে এ ‘ভোগান্তি’র মাত্রা এবং তীব্রতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। প্রতিবছরই ‘ঈদযাত্রার ভোগান্তি’ শুনে শুনে আমাদের কান রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ফলে মানুষের ভোগান্তি অসহনীয় হলেও আমাদের কানের কাছে এসব ‘ভোগান্তি’ প্রায় সহনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল উন্নতি হয়েছে, অবকাঠামোর আমূল পরিবর্তন হয়েছে, এবং নিঃসন্দেহে আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে বহুগুণ, ঢাকা শহরে ঢোকা এবং বের হওয়ার পথগুলো চার লেন, আট লেন এবং ১২ লেন হয়েছে কিন্তু ‘ঈদযাত্রার ভোগান্তি’ আমাদের কমেনি। বিশেষ করে সড়কে এই ভোগান্তির মাত্রা ক্রমহ্রাসমান হবে এরকম প্রত্যাশা থাকলেও ভোগান্তির মাত্রা দুঃখজনকভাবে ক্রমবর্ধমান।

 
১৪ জুন অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং কাগজে ছাপা সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন ভার্সনের প্রধান শিরোনাম ছিল এরকম: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১২ কিলোমিটার যানজট, ঢাকা সিলেট রোডে ১৩ কিলোমিটার যানজট, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেস রোড দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে যাওয়ার পথে শুধু টোল প্লাজাতেই ২ কিলোমিটার যানজট, ঢাকা-গাজীপুর এক্সিট পয়েন্টে ২৩ কিলোমিটার এলাকা স্থবির, গাবতলী এক্সিট পয়েন্টে উত্তরবঙ্গের প্রায় ৪০টি জেলার মানুষ যাতায়াত করে, এখানে গাড়ি চলছে শামুকের গতিতে প্রভৃতি। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের সক্ষমতা, আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল সম্প্রসারণ মানুষের ‘ঈদযাত্রার ভোগান্তি’ আদৌ কি কমাতে পারছে? যদি না-পারে, কেন পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি।

 

এই কথা স্বীকার্য যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও যানজট কমাতে ট্রাফিক পুলিশ এবং বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মোতায়েন করা পুলিশের চেষ্টা, আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার কোনও অভাব নেই। বিশেষ করে বছরের বিভিন্ন সময় ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ থাকলেও ঈদযাত্রার সময় রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশকে খররোদে দাঁড়িয়ে অমানবিক পরিশ্রম করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং এককভাবে শুধু ট্রাফিক পুলিশকেই ঈদযাত্রার এ ভোগান্তির জন্য দায়ী করা যাবে না।

তাহলে কেন সড়কপথে ঈদ যাত্রার এসব ভোগান্তি? কা‍র্যকারণ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, দূরপাল্লার বাসগুলো যত্রতত্র পার্কিং করা, যেখান সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী প্রবণতা, বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী টিকেট কাউন্টার বসানোর কারণে রাস্তাগুলোতে গাড়ি থামানোর (বদ) অভ্যাস, বিভিন্ন জায়গায় হকারদের রাস্তা দখল এবং বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস বসে যাওয়া কারণে রাস্তাগুলো পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করতে না-পারা, কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে নতুন করে যানজট সৃষ্টি হওয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোর মহাসড়কে কারণে-অকারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া, কোরবানির পশু বহনকারী পিকআপ ট্রাকের ক্রমব‍‍র্ধমান আধিক্য এবং মানুষের ট্রাফিক রুল না-মানার ক্রমব‍‍র্ধমান প্রবণতা প্রভৃতি।

এছাড়াও সত্যিকার অ‍‍র্থে বাংলাদেশের মহাসড়কের আলাদা চরিত্র বলে কোনও কিছু নেই। মহল্লার গলি আর দূরপাল্লার মহাসড়ক যেন চরিত্রগতভাবে একাকার হয়ে গেছে। কেননা, এই মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস চলাচলের পাশাপাশি টেম্পো , রিকশা, ভ্যান, মোটররিকশা, গরু বহনকারী পিকআপ, সিএনজি স্কুটার এবং বেপরোয়া বাইকারদের যত্রতত্র যাতায়াত মহাসড়কের চরিত্রটাই নষ্ট করেছে ফেলেছ। ফলে, বাড়ি ফেরার আনন্দ নিয়ে মানুষকে সড়কে কোনও বাস যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে তার সম্ভাবনা স্বাভাবিক কারণে কমে যায়। ফলে, রাস্তায় যানজট বেড়ে যায় এবং যানজট বেড়ে যাওয়ার কারণে জনগণের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। আবার একই সময়ে লক্ষ লক্ষ যাত্রীদের বহন করার জন্য হাজার হাজার বাস একই পথ দিয়ে যখন বের হয় স্বাভাবিক কারণেই ধারণ ক্ষমতার বিবেচনায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে যানজট অনিবার্য হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাজার হাজার প্রাইভেটকার।  

মানুষ পরিবার নিয়ে ঢাকা শহর থেকে বের হয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঈদ করতে যায়। বাসের ভোগান্তি কমাতে পরিবার নিয়ে অনেকে প্রাইভেটকার নিয়ে ঢাকা থেকে ঈদ করতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাত্রা করে। ফলে এই হাজার হাজার প্রাইভেটকারের একটা বাড়তি চাপ বাংলাদেশের সড়কগুলোকে নিতে হয় বলে যানজট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এখন কথা হচ্ছে এই বিষয়গুলো আমরা সবাই কম বেশি জানি। তাই, কেন মহাসড়কে যানজট হচ্ছে সেটা বিশ্লেষণ করার জন্য সড়ক বিশেষজ্ঞ বা ট্রাফিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নাই। আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার ভিতরেই আমরা এর একটা কার্যকারণ খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। তাহলে কেন ঈদযাত্রার এ ভোগান্তি কমছে না?

আমার বিশ্লেষণ হচ্ছে, কোনও একটা পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে একটা প্রায়োগিক এবং বাস্তবোচিত নিড অ্যাসেসমেন্ট (প্রয়োজন-মূল্যায়ন) জরুরি যাতে করে প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আবার যদি পরিকল্পনা-ওয়ান যেকোনও কারণে ব্যর্থ হয়, তখন পরিকল্পনা-টু’র মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করারও বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হয়। কিন্তু মানুষের ঈদযাত্রাকে সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও আনন্দময় করার জন্য আদৌ কোনও নিড অ্যাসেসম্যান্ট করা হয়েছে কিনা আমরা জানি না। অন্তত, রাস্তার পরিস্থিতি বলে, খুব কা‍র্যকর কোনও নিড-অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। যদি প্রাক্টিক্যাল কোনও নিড-অ্যাসেসমেন্ট হয়ে থাকে, তাহলে কর্তৃপক্ষের এটা না-জানার কোনও কারণ নেই যে ১৩ তারিখ বাংলাদেশের সব সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান ঈদের ছুটি হয়ে গেছে। বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতেও ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে ১৩ তারিখের পর থেকে। ফলে ১৩ তারিখ বিকালে বা রাতের পর থেকে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ঢাকা শহর ত্যাগ করবে এটা তো কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। তাহলে কেন ১৪ তারিখ ঢাকা শহর থেকে বের হওয়ার সব এক্সিট-পয়েন্টে এরকম দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হলো? কেন কর্তৃপক্ষ একটা বড় সংখ্যক মানুষের ঢাকা ছাড়ার খবর জানার পরেও যাতে কোনোভাবে যানজট সৃষ্টি না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলো না বা নিলেও কেন সেটা কা‍র্যকর হলো না? আমি মনে করি আমাদের যথেষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, নিঃসন্দেহে আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে এবং আমাদের কারিগরি দক্ষতাও বেড়েছে কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেওয়া এবং তার কার্যকর বাস্তবায়নে কোনও একটা জায়গায় একটা বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। আমাদের সেই জায়গায় মনোযোগ দিতে হবে; অন্যথায় ‘ঈদযাত্রায় ভোগান্তি’ এই শব্দবন্ধ যে ইতোমধ্যে আমাদের ঈদ-সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, সেটা ঈদ আনন্দের মধ্যে একটা দুঃখের অনুষঙ্গ ছাড়া কোনও কিছু নয়।  

এখানে আরও একটি বিষয় বলে রাখার জরুরি যে আমরা সবকিছুর জন্য সরকারকে দায়ী করি কিন্তু আমার নিজেরা কতটা আইন মেনে চলি, আমরা রাস্তায় নিজেরা কতটা বিবেচনাপ্রসূত আচরণ করি, আমরা নিজেরা কতটা যানজট যাতে সৃষ্টি না হয় তার জন্য সংযত আচরণ করি, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। আমরা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়াহুড়োর কারণে নিয়ম-কানুনের কোনও বালাই করি না, ট্রাফিক আইনের কোনও তোয়াক্কা করি না এবং সড়কে-মহাসড়কে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে যানজট সৃষ্টির জন্য নিজেরাও একটা অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছি, সেটাও আমাদের স্বীকার করতে হবে।

ফলে, ‘ঈদযাত্রায় ভোগান্তি’ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

তবে আশার কথা হচ্ছে এবার ঈদযাত্রায় ট্রেনের কোনও শিডিউল বিপ‍‍র্যয় ঘটেনি এবং লঞ্চঘাটেও তেমন কোনও ভোগান্তির সংবাদ এখন পর্যন্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। কেবল সড়কে ‘ঈদযাত্রায় ভোগান্তি’ একটি কলঙ্ক-তিলক নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ঈদের আগে এখনও এক-দুইটা দিন বাকি আছে। আমরা আন্তরিকভাবে চাইবো, এর মধ্যে আর যেন কোনও ‘ঈদযাত্রায় ভোগান্তি’ না হয়; যাতে পরিবারের সঙ্গে, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে ঈদ উদযাপন করতে সবাই যেন যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে নিজ নিজ ‘দেশ’-এ পৌঁছাতে পারে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


👇Comply with extra 👇
👉 bdphone.com
👉 ultraactivation.com
👉 trainingreferral.com
👉 shaplafood.com
👉 bangladeshi.assist
👉 www.forexdhaka.com
👉 uncommunication.com
👉 ultra-sim.com
👉 forexdhaka.com
👉 ultrafxfund.com
👉 ultractivation.com
👉 bdphoneonline.com

Uncomm

Share
Published by
Uncomm

Recent Posts

That is the POCO X7 Professional Iron Man Version

POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…

9 months ago

New 50 Sequence Graphics Playing cards

- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…

9 months ago

Good Garments Definition, Working, Expertise & Functions

Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…

9 months ago

SparkFun Spooktacular – Information – SparkFun Electronics

Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…

9 months ago

PWMpot approximates a Dpot

Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…

9 months ago

Keysight Expands Novus Portfolio with Compact Automotive Software program Outlined Automobile Check Answer

Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…

9 months ago