Categories: Bangladesh News

ঈদে মাংস খেতে বছরজুড়ে সঞ্চয়!


রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পীরগাছা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন ঝর্ণা বেগম ও লতা বেগম। ১০ থেকে ১৫ বছর আগে মানুষকে একত্র করে নিজ এলাকায় গড়ে তোলেন দুটি ‘মাংস সমিতি’। উদ্যোগটি ধীরে ধীরে স্থানীয় লোকজনের আস্থায় আসে। গরিব-অসহায়দের জন্য মাংস কেনা বরাবরই কঠিন। তারা সমিতির সদস্য হয়ে চাঁদা দিয়ে বছরজুড়ে সঞ্চয় করেন। জমানো টাকা দিয়ে ঈদ উৎসবে গরু কিনে জবাই করে সবাই মাংস ভাগ করে নেন। এতে কম দামে পরিবারের সবাই মাংস খেতে পারেন।

বর্তমানে বাজারে মাংসের দাম আকাশচুম্বী। ইচ্ছা থাকলেও সবার সামর্থ্যে তা জোটে না। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের কাছে তো অধরা। ক্রমাগতভাবে দাম বাড়তে থাকায় তারা পরিবার নিয়ে ঈদ আনন্দ করতে পারেন না। এ কারণে ঝর্ণা ও লতার মাংস সমিতির উদ্যোগ এখন রাজশাহীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে ঝর্ণা বেগম বলেন, এ বছর আমাদের সমিতির সদস্যসংখ্যা ৩১। মোট চাঁদা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছি। বাকি টাকা দিয়ে একটি খাসি কিনে সব মাংস ভাগ করে নেবো। অতিরিক্ত টাকা আগামী বছরের চাঁদার সঙ্গে যোগ হবে।

তিনি আরও বলেন, গত বছরও আমরা একেক সদস্য ১৪ কেজি করে মাংস পেয়েছি। আমাদের সমিতির সদস্যরা হলেন রিকশা ও ভ্যানচালক, দরিদ্র, চাকরিজীবী, নিম্নবিত্ত লোকজন। যারা বেশি দামে মাংস খাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন। কিন্তু সমিতির সদস্য হয়ে এখন সহজেই খেতে পারছেন।

এমন উদ্যোগ শুধু রাজশাহীর একটি গ্রাম নয়, মহানগরসহ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে মাংস সমিতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

গরুর মাংসের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় দিন দিন সমিতির সংখ্যা যেমন বাড়ছে। তেমনি এখন শুধু নিম্ন-মধ্যবিত্তই নয়, এসব সমিতিতে যোগ দিয়েছেন ধনীরাও। তাদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিজীবীরা।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গোচর, কুশাবাড়িয়া, পিয়াদাপাড়া, বাউসা, তেঁতুলিয়া, দীঘা, সরেরহাট, মনিগ্রাম, বলিহার, হরিরামপুর, মীরগঞ্জ, চণ্ডীপুর, ছয়ঘটি, খায়েরহাট, জোতরাঘোব, পীরগাছা, নূরনগর, আড়পাড়া, কিশোরপুর, চকরাজাপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে পাঁচ শতাধিক সমিতি গড়ে উঠেছে। সমিতির সদস্যরা সপ্তাহে ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে জমা দেন। কেউ দেন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। অনেকে আবার বছরের পুরো টাকা একত্রে দেন। এভাবে টাকা জমিয়ে ঈদুল ফিতরের আগে গরু কেনা হয়। সেই গরু জবাই করে মাংস ভাগ করে নেন সমিতির সদস্যরা। চামড়া বিক্রির টাকা ফান্ডে জমা থাকে। এতে দরিদ্র পরিবারগুলো আনন্দ নিয়ে ঈদ উদযাপন করে এবং তাদের আর্থিক চাপও কমে যায়।

রাজশাহীর পবা উপজেলার দামকুড়া থানার মুরারীপুর নিচপাড়া এলাকা। এ এলাকায় অন্তত ২০০ পরিবারের বসবাস। এখানকার হাতে গোনা দু-একটি পরিবার ছাড়া সবাই নিম্ন-মধ্যবিত্ত। যাদের সিংহভাগের পেশা কৃষি। অভাব-অনটনের মধ্যেও অধিকাংশ পরিবারে ঈদের দিন ভালো খাবারের আয়োজন করেছে মাংস সমিতি।

একটি মাংস সমিতির সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন পবা উপজেলার দামকুড়া থানার মুরারীপুর নিচপাড়া এলাকার সজীব হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় অধিকাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। যারা ঈদের সময় পরিবার-পরিজনের জন্য নতুন পোশাকসহ অন্যান্য বাজার করার পর মাংস কিনে খেতে পারেন না। অনেক পরিবার ব্রয়লার মুরগির মাংস দিয়েই সাধ মেটান। আবার কেউ কেউ মাছ দিয়েও ঈদে খাবারের আয়োজন করেন। এ কারণে গত বছর অনেকটা গল্পের ছলেই মাংস সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়। দিন দিন এ পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

একটি সমিতির সদস্য মো. ইয়াসিন আলী বলেন, প্রতি সপ্তাহে ১০০ টাকা করে মাংস সমিতি দেয়। গরুর মাংসের যে দাম, তাতে আর মাংস খাওয়া আর হবে না। সমিতির মাধ্যমে এবার প্রায় সাত কেজি মাংস পেয়েছি। পরিবারের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনের জন্য মাংস নিয়ে ভাবতে হয়নি। বিগত বছরগুলোয় এমন সময়ে ধার করতে হয়েছে।

সদস্য মিনারুল ইসলাম বলেন, একজনের আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হয়। ঈদের সময় পরিবারের জন্য পোশাক কিনতেই হাত খালি হয়ে যায়। এর মধ্যে ঈদের সময় আত্মীয়স্বজন আসে। সব মিলিয়ে অনেক ধার হয়ে যায়। অনেক সময় ঋণ পর্যন্ত নিতে হয়। তবে এবার আর মাংস নিয়ে বাড়তি কোনও চিন্তা নেই। কষ্ট করে প্রতি সপ্তাহে যা জমিয়েছি, তা দিয়েই এবার ঈদে তৃপ্তিসহকারে মাংস খেতে পারবো।

রাজশাহী নগরীর বাটার মোড় এলাকা তৌসিফ উদ্দিন বলেন, নগরীতে এই প্রথা কম হলেও, উপজেলা পর্যায়ে বেশি। তাই আমার নানার বাড়ি এলাকায় একটি সমিতির মাধ্যমে প্রতি বছর সঞ্চয় করি। প্রতি মাসের চাঁদা বিকাশের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই। সেই টাকা দিয়ে ঈদের সময় গরু কিনে ভাগ করে নিই। নানার বাড়িতে গিয়ে ঈদের আগে মাংস নিয়ে আসি। বাজারের চেয়ে দমও কম পড়ে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মহিশালবাড়ী গ্রামে মাসুদ রানা রুবেল সরকারি চাকরি করেন ছোট পদে। তবে ঈদে পরিবারের সবার পোশাক কিনতে গিয়ে তার টাকা শেষ হয়ে যায়। তাই আগে থেকে সমিতির মাধ্যমে টাকা সঞ্চয় করে ঈদের আগে গরু ক্রয় করে থাকেন। এতে করে মাংস ক্রয় করা নিয়ে তেমন বেগ পেতে হয় না।

বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভালো। তারা নিজেরা সঞ্চয়ী হচ্ছেন। বছরব্যাপী সঞ্চয় করা টাকা দিয়ে ঈদের আগে গরু কিনলে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে না। উপরন্তু ঈদে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সবাই ভালো খাবারও খেতে পারলো। মাংস সমিতি শুধু মাংসের জন্য নয়, এতে এলাকার মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, শুধু ধর্মীয়ভাবেই নয়, গ্রামে গ্রামে উৎসব উদযাপনকেন্দ্রিক এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসনীয়। নিজেদের চাহিদা পূরণে এক মুঠো করে চাল জমিয়ে নানা উৎসব আয়োজনের সামাজিকতা বহু পুরোনো। তেমনিভাবে এখন গ্রামে গ্রামে মাংস সমিতিও প্রশংসনীয়। তবে শুধু একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থেকে একটি পণ্য নয়, সবাই মিলে সামাজের আরও যত সমস্যা আছে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাধান করতে হবে। তবেই একটি সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে সুশিক্ষিত মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে ক্যাবের রাজশাহী শাখা সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, সামাজিক এমন প্রথা বহু আগের। সম্প্রতি এসব প্রচলনও তেমন নেই। কিন্তু এখন বাজারে ব্যবসায়ী অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এসব সমিতি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় এটা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়।

Uncomm

Share
Published by
Uncomm

Recent Posts

That is the POCO X7 Professional Iron Man Version

POCO continues to make one of the best funds telephones, and the producer is doing…

6 months ago

New 50 Sequence Graphics Playing cards

- Commercial - Designed for players and creators alike, the ROG Astral sequence combines excellent…

6 months ago

Good Garments Definition, Working, Expertise & Functions

Good garments, also referred to as e-textiles or wearable expertise, are clothes embedded with sensors,…

6 months ago

SparkFun Spooktacular – Information – SparkFun Electronics

Completely satisfied Halloween! Have fun with us be studying about a number of spooky science…

6 months ago

PWMpot approximates a Dpot

Digital potentiometers (“Dpots”) are a various and helpful class of digital/analog elements with as much…

6 months ago

Keysight Expands Novus Portfolio with Compact Automotive Software program Outlined Automobile Check Answer

Keysight Applied sciences pronounces the enlargement of its Novus portfolio with the Novus mini automotive,…

6 months ago