প্রায় ২০০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়ি তৈরির দাবি করেছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ নোয়াপাড়া এলাকার আল আমিন তাঁতি। ৩০০ থেকে ৪০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে নানা ডিজাইনের মসলিন শাড়ি তৈরি করে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছেন। খুব শিগগিরই ৫০০ কাউন্টের সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করবেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে স্বীকৃতি পাননি এই তাঁতি। তবু মসলিন শাড়ি নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন তিনি। এদিকে মসলিন শাড়ির বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তারা। এসব নিয়ে আল আমিনের সঙ্গে বিরোধের কথাও জানিয়েছেন তারা।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া বিসিক জামদানি পল্লিতে বসবাস করেন মসলিন শাড়ি তৈরির কারিগর আল আমিন। এ পর্যন্ত ৯টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন বলে দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ দৃক গ্যালারির সিইও সাইফুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় ও সহায়তায় অনেক তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তবে কোনও তাঁতি সফল হতে পারেনি। ওই সময় সাইফুল ইসলাম ভাই আমার কাছে চিকন সুতা নিয়ে আসেন এবং মসলিন শাড়ি বোনার কথা বলেন। এরপর থেকে আমার চেষ্টা শুরু হলো। তবে সূক্ষ্ম সুতার কারণে শাড়ি বুনতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে প্রায় ৬ মাস পেরিয়ে গেলো। সুতা ছিঁড়ে যাওয়ার বিড়ম্বনায় আরও প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলো। এছাড়া আর্দ্রতার একটা বিষয় রয়েছে। রোদ উঠলে সুতা ছিঁড়ে যেতো। এ কারণে ভোর থেকে সকাল ৯টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ চলে অবিরাম। তবে এতো ঝামেলার কারণে অনেকে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ বন্ধ করার পরামর্শও দিয়েছিল। আমি ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। অবশেষে আরও ৯ মাস চেষ্টা চালিয়ে একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে সফল হই। ৩০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে শাড়িটি তৈরি করা হয়। সেই শাড়ি ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগের জাদুঘরে এক্সিবিশনে ঠাঁই পেয়েছে। সেখানে পুরষ্কারও পেয়েছি। ওই এক্সিবিশনে আসা দর্শনার্থীদের মাধ্যমে বহু শাড়ি তৈরির অর্ডার পেয়েছি। তবে এত অর্ডার নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে প্রায় ৯ মাস সময় লেগে যায়। তাছাড়া ওই এক্সিবিশনের ফলে যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের স্বনামধন্য লোকজন তাকে দেখতে চেয়েছেন। তবে নানা কারণে বিদেশে যাওয়া হয়নি তার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় জাদুঘরে মাসব্যাপী মসলিন প্রদর্শনীতে প্রায় এক লাখের বেশি দর্শনার্থী এসেছিলেন। দুই শতাধিকের বেশি ছিলেন বিদেশি কিউরেটর। সেখানে মসলিনভিত্তিক ফ্যাশন শো, কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেই প্রদর্শনীতে আল আমিনের মসলিন শাড়ি প্রদর্শিত হয়েছিল। উৎসবের অর্থায়নে দৃকের সঙ্গে ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও ব্র্যাকের আড়ং।
সারাদেশের মধ্যে আল আমিন একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরির কারিগর দাবি করে বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে এখন আমি একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরির তাঁতি (কারিগর)। এছাড়া আর কেউ এই শাড়ি তৈরি করতে পারে না, কিংবা কেউ পারলেও তা করতে চায় না। এর কারণ এই শাড়ি তৈরি করতে অনেক ধৈর্য্যের প্রয়োজন। তাছাড়া এত ঝামেলা করে কেউ শাড়ি বুনতে চায় না। এছাড়া কয়েকবছর আগে রূপগঞ্জে সরকারিভাবে মসলিন শাড়ি তৈরির প্রকল্প চালু হয়েছিল, নানা কারণে গত ৭-৮ মাস আগে সেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশে আমি এখন একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরির তাঁতি। বহির্বিশ্বে এই মসলিন শাড়ির অনেক চাহিদা। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড (যুক্তরাজ্য), ভারত ও সিঙ্গাপুরে এই মসলিন শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব দেশ থেকে অনেক অর্ডার পেয়েছি। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ভারতে একাধিক ও বাংলাদেশে একটি শাড়ি বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে শাড়ির বিক্রির কথা চলছে।
আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে ফ্রান্স ও লন্ডনে ৪টি মসলিন শাড়ির ডেলিভারি দেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৯টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছি। ৩০০ থেকে ৪০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে এসব শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে ৩০০ কাউন্টের সুতা ১৫ হাজার রুপি ও ৪০০ কাউন্টের সুতা ২০ হাজার রুপি দিয়ে কিনে আনা হয়। দৃক গ্যালারির সাইফুল ইসলাম সর্বপ্রথম এই সুতার সন্ধান দিয়েছিলেন। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে এই সুতা তৈরি করা হয়ে থাকে। আল আমিনের হাতে তৈরি প্রতিটি শাড়ির দৈর্ঘ্য ৬ গজ এবং প্রস্থ ৪৭ ইঞ্চি এবং ওজন প্রায় আড়াইশ গ্রাম। শাড়ির ডিজাইন ও সুতার কাউন্টের ওপর নির্ভর করে দাম কম-বেশি হয়ে থাকে। তবে আনুমানিক প্রত্যেকটি শাড়ি তৈরিতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়। এই খরচের টাকা দৃক গ্যালারির সিইও সাইফুল ইসলাম দিয়ে আসছেন। তবে শাড়ি বিক্রির সম্পূর্ণ টাকা তাকে দেওয়া হয়। সম্প্রতি ৪টি শাড়ির কাজ সম্পন্ন করেছেন। আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে যাবে এসব শাড়ি। প্রতিটি শাড়ি ৫-৬ লাখ টাকায় বিক্রি হবে। আসন্ন ঈদের আগে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মসলিন শাড়ি বিক্রি হবে বলে তিনি জানান। আর ঈদের পর থেকে ৫০০ কাউন্টের শাড়ি তৈরি করবেন বলে আল আমিন জানান।
সরকারিভাবে কোনও সহযোগিতা পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সাধারণত আড়াইশ কাউন্ট থেকে শুরু করে ১২০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে নতুন করে সরকারিভাবে ৭০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা হয়েছে। এমনিতে মসলিন শাড়ি তৈরিতে সরকারিভাবে কোনও ধরনের সহযোগিতা পাইনি। তবে সরকারিভাবে তৈরিকৃত ৭০০ কাউন্টের সুতা আমাকে দেওয়ার কথা চলছে। এসব সুতা আমাকে দেওয়া হলে এই আঙ্গিকে কাজ শুরু করবো। আমার অধীনে একজন তাঁতি ও তার একজন সহযোগীকে মসলিন শাড়ি তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, তারা হলেন- মো. রনি ও তার সহযোগী সুলতানা। এছাড়া আর কেউ এই শাড়ি তৈরি করার আগ্রহ দেখায়নি।
মসলিন শাড়ি নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন আল আমিন মিয়া। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে চান তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রায় দুইশ বছর আগে মসলিন শাড়ি এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর মসলিন তৈরির কারিগররা কেউ বেঁচে নেই। সুতরাং মসলিন তৈরির কাজ শেখার কোনও সুযোগ নেই। আমি মূলত জামদানি শাড়ি তৈরির তাঁতি। সেখান থেকে দৃকের সাইফুল ইসলাম ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় ও সহযোগিতায় মসলিন শাড়ি তৈরি করেছি। এটা আমি নিজে নিজে শিখেছি। আমার ইচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়ি নিয়ে আগামীতে আরও কাজ করার। যাতে করে দেশের সুনাম ও ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বের সামনে আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে পারি। এটা যেন দেশের ইতিহাস হয়ে থাকে, আর সেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে আমার নাম সবাই স্মরণ করবে। এক কথায় এই মসলিন নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রয়েছে।
মসলিন শাড়ি তৈরিতে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব উল্লেখ করে আল আমিন বলেন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে মসলিন শাড়ি তৈরির শিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানো যাবে। একারণে সরকারি সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। মসলিন শাড়ি তৈরিতে বড় ও প্রশস্ত স্থানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আর শাড়ি তৈরির স্থানের চারপাশে পুকুর ও গাছপালা থাকতে হবে যাতে করে তাপমাত্রা নিয়ে কোনও সমস্যা না হয়। কারণ মসলিন শাড়ি তৈরির জন্য আর্দ্রতা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই শাড়ি তৈরিতে ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রয়োজন। এছাড়া বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান থাকতে হবে।
বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার শাড়ি বিক্রি করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে মসলিন শাড়ি তৈরি করে খুব ভালো আছি। ব্যবসা খুব ভালো চলছে। মসলিনের কারণে রূপগঞ্জসহ সারা দেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছি। এ কারণে অনেকে দেখতে আসে। এছাড়া মসলিনের পাশাপাশি জামদানি শাড়ি তৈরি করি। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার শাড়ি বিক্রি করে থাকি।
মসলিন তৈরির কারিগর আল আমিনের বাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, তার বাড়িতে ‘বেঙ্গল মসলিন কেন্দ্র’ নামে ছোট্ট একটি কক্ষে মসলিন কাপড়ের ইতিহাসসহ মসলিন কাপড়ের তৈরি রুমাল ও কাপড়ের প্রদর্শনী করা হয়েছে। এর পাশেই মসলিন ও জামদানি তৈরির কাজ চলছে।
বর্তমানে আল আমিন একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরির তাঁতি উল্লেখ করেন বিসিক জামদানি শিল্প নগরী ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মসলিন শাড়ি শুধুমাত্র রূপগঞ্জে তৈরি করা হয়। এর মধ্যে সরকারিভাবে গড়ে ওঠা মসলিন শাড়ি তৈরির প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সেটা কেন বন্ধ হয়েছে তা বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বলতে পারবে। আর এখন জামদানি বিসিক পল্লীতে বসবাসকারী আল আমিন নামে এক ব্যক্তি বেসরকারিভাবে মসলিন শাড়ি তৈরি করে। আমার জানা মতে, তিনি শুধু নারায়ণগঞ্জ জেলায় নয় সারা বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরি করেন। তবে এটা সরকারিভাবে সহযোগিতা করলে মসলিন শাড়ির ঐতিহ্য আরও প্রসার করা সম্ভব। তবে এটা কেন করছে না তা তাঁত বোর্ড বলতে পারবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘রূপগঞ্জে সরকারি প্রকল্পের অধীনে রিসার্চের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এতে তাঁতিসহ সাড়ে ৩০০ দক্ষ লোক তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৬ জন সুতা কাটার কর্মী এবং তাঁতি ও তার সহকারীসহ ৩৪ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তারা সবাই এখন জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ করছে। প্রকল্পের কাজ শুরু হলে তারা খুব শিগগিরই মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করবে। আপাতত এই তাঁতিরা মসলিন তৈরি করছে না বলে জানিয়েছেন।
মসলিন শাড়ি নিয়ে আল আমিনের সঙ্গে তাদের বিরোধ রয়েছে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, দৃক গ্যালারির সাইফুল ইসলাম আমাদের রিসার্চ টিমের একজন সদস্য ছিলেন। আর মসলিন নিয়ে শুরু থেকে আল আমিন আমাদের সঙ্গে অনেক বিরোধিতা করেছেন। ওনি আমাদের রিসার্চের রেজাল্ট চেয়েছেন। আমরা তাকে দেইনি। সে যদি সত্যিকার অর্থে মসলিন তৈরি করতে পারতো তাহলে জিআই পেতো। মসলিন কাপড় তৈরি করতে তিনটি বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকতে হবে। প্রথমত, ফুটি কার্পাস তুলা থেকে সুতা হতে হবে। দ্বিতীয়ত, হাতে চরকার তৈরি সুতা হতে হবে। তৃতীয়ত, পিট লুমে তৈরি হতে হবে। অথচ আল আমিন ভারত থেকে সুতা এনে মসলিন তৈরি করছেন। তবে সে ভালো মানের কাপড় তৈরি করছে।