বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে জ্ঞানের সমাহার। জ্ঞানের অতল সাগর। যেখানের জ্ঞান দিয়ে পাহাড়, পর্বত, হিমালয় ও পৃথিবীকে জয় করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা জায়গাই জ্ঞানের সমাহার। বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেও জ্ঞান অর্জন হয়। এজন্য সব শিক্ষার্থীর স্বপ্নই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার।
কিন্তু ইদানিং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের চোখে ভেসে ওঠে শ্লীলতাহানি, মানসিক টর্চার, র্যাগ, যৌন হয়রানির মতো ঘটনাগুলো। বাংলাদেশে নারীদের জন্য উচ্চ শিক্ষা এমনিতেই নানান কারণে বাঁধা, তার উপর এমন গর্হিত কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র জায়গায় হলে, তা নারীদের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। অভিভাবকরাও তাদের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো বন্ধ করে দিবে। আর তা হবে, বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার বাঁধা।
বাংলাদেশে অ্যাকাডেমিক শিক্ষার শেষ পর্যায় হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের সেবার জন্য তৈরি হয়ে উঠে। এতোদিনের অর্জন বিলিয়ে দিবে সমাজ ও রাষ্ট্রের তরে। সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। দেশ ও দশের সেবা করবে। মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে। নিজেকে একজন আদর্শিকে হিসেবে গড়ে তোলে। আর এ কাজের জন্য মূখ্য ভূমিকা পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আর এ শিক্ষকের সম্মান একজন শিক্ষার্থীর কাছে তার মা-বাবার পরেই।
একজন আদর্শবান শিক্ষক তার আদর্শ দিয়ে সমাজ ও দেশ পরিবর্তন করতে পারেন। বদলে দিতে পারেন গোটা সমাজ রাষ্ট্রকে। সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল তার বাস্তব প্রমাণ। যাদের আদর্শ আজও বিদ্যমান।
খুব আক্ষেপ করেই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই কথাটি বলেছিলেন, ‘দেশ ভালো হবে, যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’ মানুষ গড়ার কারিগর হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু মানুষ হলো কোথায়? হবেই বা কী করে? যেখানে সাধু শিক্ষকের আড়ালে লুকিয়ে আছে অশ্লীল, ভদ্র শয়তান, ধর্ষণকারী। যাদের উদ্দেশ্য থাকে সুযোগ বুঝে নিজের কামভাব চেতনাকে জাগ্রত করা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিন দিন যৌন নিপীড়নের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এর আকার বেড়েই চলেছে। এর জন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা জাতি লজ্জিত। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি পুরো জাতি কলঙ্কিত হয়।
বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৫টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৪ টি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫টির মধ্যে যৌন নিপীড়নের সেল আছে ৪৫টিতে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১৪ টির মধ্যে সেল আছে ৯৭টিতে। মোট ১৬৯টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবগুলোতেই যৌন হয়রানি হয়ে থাকে। তবে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সবচেয়ে বেশি নাজুক।
প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়, কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী তার সহপাঠী বা শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছরে পাঁচ শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি, চট্টগ্রাম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি করে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এটা যারা সেলে অভিযুক্ত করেছে তাদের সংখ্যা। অভিযোগ করেনি এমন সংখ্যা তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন যৌন হয়রানি হয়, তার একটা জরিপ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আলীম। তিনি জরিপ করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ২০০ ছাত্রীদের নিয়ে। জরিপটি ছিল ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। তার গবেষণায় উঠে আসে যৌন নিপীড়নের ছোট্ট একটি চিত্র।
তিনি বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ ছাত্রী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন না। কারণ যাদের দ্বারা এমন কাজ হয়, তারা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনও নীরব ভূমিকা পালন করে। পূর্বের ঘটনায় কোনো প্রতিকার না পেলে অন্যরাও অভিযোগ করে না। অভিযোগ না করার আরও বড় কারণ হলো চরিত্র হনন ও নিরাপত্তার হুমকি। এই নিরাপত্তা ও চরিত্র হননের ভয়ে ৯০ শতাংশ ছাত্রী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কোনো পদক্ষেপ নেন না। আবার ওই শিক্ষকের কোর্সে ফেইলের আশঙ্কাও কাজ করে।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৬%, সিনিয়র জুনিয়র কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার ২৪%, শিক্ষক কর্তৃক ৯% এবং বহিরাগত ১১%।
প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীরা কি আদৌ নিরাপদ? উচ্চশিক্ষার জন্য তারা কোথায় যাবে? সে পরিবেশ কী সরকার, রাষ্ট্র করে দিতে পারে? অভিভাবকরা কী নিশ্চিন্তে থাকতে পারে এমন পরিবেশ নিয়ে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের তেমন শাস্তিযোগ্য আইন নেই বললেই চলে। ২০০৮ সালের এক রিট আবেদনের পর ২০০৯ সালের ১৪ মে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু তারও বাস্তব রূপ নেই। এমন ঘটনার জন্য ১২০ দিনের মধ্যে সমাধান করার কথা, অথচ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। কিন্তু ঘটনার কোনো সুরাহা হয় না।
যেখানে জাতি গঠন হয়, সেখানেই যদি এমন নোংরামি চলে, তাহলে জাতি যাবে কার কাছে? আইন দিয়েই বা কী হবে? তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থী বা জাতি কিই-বা শিখবে। বাবা-মায়েরা কী সার্বক্ষণিক তাদের সন্তানদের পাহারা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করবে? এমন অসুস্থ বিকৃত মস্তিষ্কের শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয় কীভাবে? টাকার জোরে, ক্ষমতার জোরে এখন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের আচরণ কেমন, কী করতো, ছাত্র জীবন কেমন ছিল তা জানার প্রয়োজন মনে করে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাঙ্গনে এমন নোংরা ঘটনা হামেশা ঘটে যাচ্ছে।
শুধু ছাত্রীরা যে যৌন হয়রানির শিকার তা নয়। বরং নারী শিক্ষকরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পান না। সহকর্মী হিসেবে তাদের সঙ্গে যেমন আচরণ করার কথা তেমন আচরণ না করে অশ্লীল ভঙ্গিতে বা কথায় আক্রমণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এমন ঘটনা বহু ঘটেছে। এখন সব জায়গায় ছড়িয়েছে। কিন্তু কেউ বলতে চায় না লজ্জায়।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, নারী তার প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই যৌন হয়রানির শিকার। যারা এমন কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া তেমন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। যাদের স্থায়ী বরখাস্ত করা হয়, তাদের নামে ফৌজদারি মামলা করা যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ওই পর্যন্তই নীরব।
অথচ তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তি ও অপমানজনক কিছু করা গেলে বাকিরাও সঠিক হওয়ার পথে এগিয়ে আসত। মিডিয়ায় না আসা পর্যন্ত প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয় না, শাস্তিও দেয় না। প্রশ্ন জাগে, তারাও কি এটাকে সমর্থন করে? দুধ কলা দিয়ে তো তারাই কালসাপ লালন করে। নইলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঠিক তদন্ত না করে ফেলে রাখে কীভাবে? এমন নোংরা শিক্ষকের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে তাদের ১০ বার ভাবায় কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কর্তৃক দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহিতার অভাবে এমন কাজ হচ্ছে। সময়মতো তদন্ত করতে হবে। সঠিক তদন্ত করে সময়মতো রিপোর্ট জমা দিতে হবে। যত বড় প্রভাবশালী হোক, শক্তিশালী হোক- প্রশাসনের উর্ধ্বে নয়, আইনেরও উর্ধ্বে নয়। তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ও অপমানজনক শাস্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যারা এমন কাজ করে তারা রাজনীতিকেও কলুষিত করে। রাজনৈতিকভাবেও তাদেরকে পাকড়াও করতে হবে। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের মতো নোংরা কাজ ও আচরণ কমে যাবে। অন্যরাও দেখে শিক্ষা নিবে।
লেখক: শিক্ষার্থী: বাংলা বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।