Thursday, October 3, 2024

টংক আন্দোলনের কুমুদিনী | সাতসতেরো


টংক হচ্ছে এক ধরনের ‘খাজনা’। তবে টাকার মাধ্যমে এই খাজনা পরিশোধ করার ব্যাপার ছিল না। জমিতে ধান হোক বা না হোক জমিদারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান দেওয়ার মাধ্যমে এই খাজনা পরিশোধ করতে হতো। জমিদারি প্রথার এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাসও বলা চলে টংক প্রথাকে। এই প্রথা বিলুপ্তির মধ্যে দিয়ে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পথ তৈরি হয়। শুধুমাত্র তাই নয় ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনে কৃষকের সম্পৃক্ততা তীব্র হয়েছিল টংক আন্দোলনের মাধ্যমে।

টংক আন্দোলনের কিংবদন্তী নারী নেত্রী কুমুদিনী হাজং। তার জন্ম আনুমানিক ১৯৩০ সালে। কৃষিপরিবারে বেড়ে ওঠা কুমুদিনী কৃষকের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । তার পিতার নাম অতিথ চন্দ্র রায় হাজং ও মাতা জনুমনি হাজং। কুমুদিনীর দাম্পত্য সঙ্গী ছিরেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেতা লংকেশ্বর হাজং। 

জানা যায়, ময়মনসিংহের সুসং জমিদারি এলাকায় টংক প্রথার প্রচলন ছিল। সে সময় ফসল হোক বা না হোক, জমিদারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা দিতে হতো। জমিদারের এমন অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল কৃষকেরা। ১৯৩৭ সালে এই শোষিত কৃষকেরা টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন টংক আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে।

টংক এর পরিমাণ ছিলো প্রচলিত খাজনার কয়েক গুনেরও বেশি। যা দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের ছয় দফা দাবি ছিল, টংক প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি, টংক কৃষকদের ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি, পরগনায় নগদ টাকায় দেয় হারের নিরিখে খাজনা নির্ধারণ, টংক খাজনার বকেয়া দাবি না করা, জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ।

এই দাবি আদায়ে কাজ করছিলেন লংকেশ্বর। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ পুলিশ লংকেশ্বর হাজংকে গ্রেপ্তার করতে যায়। বাড়িতে গিয়ে তাকে খুঁজে না পেয়ে কুমুদিনী হাজংকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পথে রাসিমণি হাজংয়ের দলের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন। অবস্থা সামাল দিতে পুলিশ কুমুদিনী হাজংকে গ্রেপ্তার না করেই প্রস্থান করে।

এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়। স্বামীর সঙ্গে কুমুদিনীও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ‘ টংক প্রথার উচ্ছেদ চাই, জান দিব তবু ধান দিব না, জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ চাই, জমি যার,লঙ্গল তার’ ইত্যাদি স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। টংক দেওয়া বন্ধ করে দেন সকল কৃষক।

জমিদারি প্রথার ওপর ক্ষিপ্ত কৃষক ১৯৪৯ সালের ১৫ জানুয়ারি কলমাকান্দা থানার বটতলায় ২০ মণ টংক ধান আটক করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে চৈতন্যনগরে জমিদারের কাছারি দখল করে। এরপর পুড়িয়ে দেয় জমিদারের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র।

কিন্তু এই ঘটনার পর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে তাদের উপর। বিপ্লবী মঙ্গল সরকারের নেতৃত্বে একটি মিছিলে পুলিশ গুলি করলে ১৯ জন বিদ্রোহী নিহত হন। আরও অনেকে গ্রেপ্তার হন। এর মধ্যে অশ্বমণি ও ভদ্রমণি হাজং এর ১২ বছর করে জেল হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি দু’জন বন্ধুকধারী সিপাইকে বিপ্লবী কৃষকেরা ভালুকা পাড়া গির্জার সামনে হত্যা করে।

১৯৫০ সনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন সুসং দুর্গাপুর এলাকায় আসেন ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু টংক প্রথা না তুলে নেওয়ায় এই আন্দোলন চলতে থাকে। অবশেষে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাস হয়।

টংক আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নারী আন্দোলনকর্মী পরবর্তীতে রাজনীতি এবং অন্য জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। কুমুদিনী হাজং তাদেরই একজন। যিনি সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি তাকে ২০১৯ সালে সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জন করেন। ২৩ মার্চ, ২০২৪ তারিখে ১০২ বছর বয়সে মারা যান কুমুদিনী। ভালো থাকুক এই কীর্তিমান।



Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles