রাজধানীর ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থীকে অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতার কামরুল হাসান (২৮) ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানের গাড়িচালক। সে প্রতিদিন সকালে আনিসুর রহমানের ছেলে মো. জামিনুর রহমানকে (১১) গাড়িতে করে স্কুলে পৌঁছে দেয়। জামিনুর রহমান মাস্টারমাইন্ড স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
গত ২০ মার্চ সকালে কামরুল হাসান ভিকটিম জামিনুর রহমানকে নিয়ে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের সামনে পৌঁছালে সাত অপহরণকারী তাদের ঘিরে ফেলে। তারা গাড়িচালকসহ জামিনুর রহমানকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
এরপর অপহরণকারীরা ফোন করে জামিনুর রহমানের পরিবারের কাছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে নগদ ১৪ লাখ টাকা দিয়ে জামিনুরসহ গাড়িচালক কামরুলকে ছাড়িয়ে আনেন আনিসুর রহমান। ভিকটিমের পরিবার তখনও জানতো না যে, তাদের ড্রাইভার কামরুলও অপহরণকারীদের একজন।
জামিনুর ও গাড়িচালককে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনার পর ভিকটিমের পরিবার গত ২০ মার্চ ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলা দায়েরের পর ছায়াতদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রমনা বিভাগ। ছায়াতদন্তের এক পর্যায়ে গাড়িচালক কামরুল হাসানসহ সাত জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
অপহরণকারীচক্রের গ্রেফতারকৃত সদস্যরা হলো— আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে মাসুদ (৩৭), মো. নূর আলম (৩০), মো. কামরুল হাসান (২৮), মো. রনি মিয়া (৩০), মো. মনির হোসেন (৩২), মো. জনি বিশ্বাস (৪২) ও মো. আসলাম হাওলাদার। রাজধানী ঢাকাসহ কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, গ্রেফতার মাসুদ গাড়িচালক কামরুল হাসানের ভগ্নিপতি। তারা দুজন মিলে জামিনুরকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। তারাই এই অপহরণ ঘটনার মূলহোতা।
কামরুল হাসানসহ বাকি আসামিরা এ সময় জেলে ছিল। জেলে বসে পরিকল্পনা করে— বের হয়ে কীভাবে অপহরণ করা যায়। কামরুল জেলে গিয়ে তার ভগ্নিপতির কাছে জামিনুরকে অপহরণের কথা বলে। জেল থেকে জামিনে বের হয়ে তারা জামিনুরকে অপহরণ করে। ডিবি জানায়, এই চক্রটি অপহরণ করে জেলে যায়, আবার জেল থেকে বের হয়ে অপহরণ করে।
রবিবার (২৪ মার্চ) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মাস্টারমাইন্ড স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মো. জামিনুর রহমান গত ২০ মার্চ সকালে ড্রাইভার কামরুলের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছিল। সকাল সাড়ে ৭ টায় তারা স্কুলের সামনে পৌঁছালে তিন জন অপহরণকারী গাড়ি সামনে গিয়ে গতিরোধ করে। এরপর আরও চার জন অপহরণকারী গাড়ির সামনে আসে। এই সাত জন অপহরণকারী মিলে গাড়িচালক কামরুল হাসানসহ জামিনুর রহমানকে অপহরণ করে সাভারের গেন্ডা এলাকায় নিয়ে যায়। অপহরণটি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়। গাড়িচালক কামরুল হাসান হলেন চক্রটির মূলহোতা মাসুদের শ্যালক। কামরুল নিজেও এই চক্রের একজন সদস্য।
তিনি বলেন, অপহরণের পর চক্রটির একজন জামিনুর রহমানের বাবা আনিসুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। অপহরণকারীরা ভিকটিমের বাবাকে আরও বলে যদি এ ঘটনা পুলিশ কিংবা কাউকে জানানো হয়— তাহলে জামিনুর রহমানকে হত্যা করা হবে। এই হুমকির কারণে ভিকটিমের বাবা ভয় পেয়ে যান। তিনি বিষয়টি পুলিশকে জানাননি। পরে ঘটনার দিন রাতে ভিকটিমের চাচা হাবিবুর রহমান ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেন। মামলা দায়েরের পরও ভিকটিমের বাবা পুলিশকে বলেন, ‘আপনারা যাবেন না, আপনারা গেলে তারা আমার ছেলেকে হত্যা করে ফেলবে।’
ডিবি-প্রধান বলেন, ভিকটিমের বাবার কথা চিন্তা করে আর যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়— সেই চিন্তা থেকে আমরাও প্রাথমিকভাবে অ্যাকশনে যাইনি। ঘটনার দিন রাত ১০টায় ভিকটিমের পরিবার অপহরণকারীদের ১৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে জামিনুর রহমান ও গাড়িচালক কামরুল হাসানকে ছাড়িয়ে আনে। তবে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেও আমরা অপহরণকারীদের ছাড়বো না। এরপর ডিবি রমনা বিভাগ এ বিষয়ে কাজ শুরু করে। মুক্তিপণ দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে অভিযান চালিয়ে গাড়িচালক কামরুল হাসানসহ অপহরণকারী চক্রের সাত জনকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে হারুন অর রশীদ জানান, চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন ধনী ব্যবসায়ীর গাড়িচালক হিসেবে নিজেদের লোককে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এভাবে তারা তথ্য সংগ্রহের পর টার্গেট ব্যক্তিকে অপহরণ করে। নয়তো বা ধনী লোকের গাড়িচালককে কৌশিলে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ ও অপহরণ করে। এ ঘটনায় ভিকটিমের পরিবারের ড্রাইভার কামরুল নিজেই এই চক্রটির সক্রিয় সদস্য।
ডিবি-প্রধান বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অপহরণের ঘটনায় আমরা দেখেছি— এসব ঘটনায় গাড়িচালকরা জড়িত রয়েছে। মাস্টারমাইন্ডের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর অপহরণ ঘটনার মূল হোতা গাড়িরচালক কামরুল হাসান। তাই গাড়িচালক ও বাসায় কাজের বুয়া নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতার অবলম্বের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: